Science & Technology
প্রাচীন রোমে সৈন্যদের নুন দিয়ে বেতন দেওয়া হত। সৈন্যরা সেই নুন বিনিময় করে নিতে পারত তাদের প্রয়োজনীয় পণ্য। বেতন দেওয়ার এই ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছিল স্যালারিয়াম। আজ সেটাই হয়েছে স্যালারি। আর স্যালারি মানে তো আমরা সবাই জানি, তাই না? আবার বলা হয়, এই প্রাচীন রোমেই নাকি পরবর্তী সময়ে যখন বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য চালু হল মুদ্রার প্রচলন, তখন এই লেনদেনের পুরোটাই করা হত বেঞ্চে বসে। তখন এই বেঞ্চের লাতিন নাম ছিল ব্যাঙ্কু। আর সেটাই আজ হয়েছে ব্যাঙ্ক। সত্যিই, খুব অবাক লাগে এটা দেখে যে টাকা যা আসলে লেনদেনের একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়, আজ সেই টাকার জন্যই চলছে যত যুদ্ধ, প্রতিযোগিতা, পরিশ্রম। শুরুটা সেই কোন আদিকাল থেকেই। তারপর এখন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান থেকে পাড়ার মুদির দোকান। আমি, আপনি, কোটি কোটি মানুষ- গরিব, বড়লোক যার কথাই বলুন না কেন, আমরা সবাই নির্ভর করি টাকার ওপরেই। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যপার, যার জন্য এত ছোটাছুটি, সেই টাকাই কারুর হাতে সারা জীবন আটকে থাকে না। কারণ, টাকা শুধু একজনের হাত থেকে আরেকজনের হাতে ঘুরে বেরায়। যার হাতে যত টাকা, তার তত পণ্য কেনার আকাঙ্খা, প্রয়োজনীয়তা। মানে টাকা ছাড়া আজকের পৃথিবী একেবারে অচল। কিন্তু এই টাকা আজকের পৃথিবীতে এলো কিভাবে? কিভাবে জড়িয়ে পড়ল প্রতিটি মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরব টাকার সেই অ্যাডভেঞ্চারাস জার্নির ইতিহাস।
Bartering System:
চলুন ঘুরে আসা যাক আজ থেকে ১৭ হাজার বছর আগে। তখন কোথায় টাকা আর কোথায় কী? এটা ঐ সময় যখন প্রাগৈতিহাসিক মানুষগুলো ছোট ছোট গোষ্ঠী করে বেঁচে থাকত। তখন বেঁচে থাকা বলতে খাবারের সংগ্রহ। তার জন্য বন্য প্রাণী শিকার করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। যেদিন শিকার পাওয়া গেল, সেদিন ভরল পেট। না-হলে পেটে কিল মেরে বসে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আর এটাই ঐ গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে প্রথম বিনিময় প্রথা শুরু করে। মানে বিষয়টা এমন, তুমি আমাকে একটু মাংস দাও, আমি তোমাকে আমাদের তৈরি এই অস্ত্র দেব। শুরু হল লেনদেন। আর এটাই হচ্ছে সেই লেনদেনের প্রথম ধাপ। মনে করা হয় বারটারিং সিস্টেমের প্রচলন এই মেসোপটেমিয়া থেকেই। আজ যা ইরান। এই বারটারিং সিস্টেমের মাধ্যমেই প্রত্যেকে একে অপরের সঙ্গে ট্রেড করতেন।
Problems of Bartering System:
এরও প্রায় হাজার বছর পর যখন কৃষিকাজের সঙ্গে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়ল, তখন এই বারটারিং সিস্টেম নিয়ে বেশ গোলমাল দেখা দিতে শুরু করল। মানে আপনি বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে আমার থেকে পণ্য নিতেই পারেন। কিন্তু আপনি বিনিময়ের জন্য যে পণ্য দিতে চাইছেন, তার প্রয়োজন আমার কাছে নাই থাকতে পারে। অর্থাৎ সমস্যা আরও গভীর হতে শুরু করল। কে কোন জিনিস দিচ্ছেন, আর কোন জিনিস নিচ্ছেন তার জন্য মাটির ওপরে বিভিন্ন দাগ দেবার প্রচলন শুরু হল। এখান থেকেই শুরু হল এই অ্যাকাউন্টিং। মানে হিসেব-নিকেশের প্রক্রিয়া। কিন্তু সমস্যা থেকে মুক্ত কোথায়? অগত্যা আমাদের এমন কিছুর প্রয়োজন পড়ল, যা প্রত্যেকের জন্য কাজটা আরেকটু সহজ করে দেবে।
Commodity Money:
এগিয়ে আসা যাক আরও কয়েক বছর। প্রায় ২৫০০ বছর আগের কথা। তখন চালু হল কমোডিটি মানি। এমন কিছু জিনিস, যা আমরা প্রত্যেকেই ব্যবহার করতে পারব। এর ফলে ব্যবসা করাও তখন অনেকটা সুবিধের হত। যেমন গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, পশম, গম, ধান, পালক, পশুর হাড় এমনকি মানুষ। ক্রীতদাসেদের টাকা পয়সার মতনই লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হত। এমনকি প্রশান্ত মহাসাগরের ইয়াপ আইল্যান্ডে বড় বড় পাথর দেখতে পাওয়া যায়, যাকে যৌতুক হিসেবে তখন ব্যবহার করা হত।
China:
তবে মনে করা হয়, টাকা বা ধাতব মুদ্রার প্রচলন শুরু হয় চিন থেকেই। প্রায় ৩ হাজার বছর আগে। এর ফলে ব্যবসায়িক লেনদেনের সমস্যা অনেকটাই মিটে গেল। প্রচলনের গতি এতটাই মসৃণ হল যে, সেটা ছড়িয়ে পড়ল চিন থেকে তুরস্ক হয়ে একেবারে গ্রিস পর্যন্ত। এমনকি ভারতেও ধাতব মুদ্রার প্রচলন সেই সময় শুরু হয়। ২৪০০ বছর আগে চাণক্যর অর্থশাস্ত্রে ধাতব মুদ্রার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এটাও তো এক ধরণের কমোডিটি মানি। কিন্তু এই ধাতব মুদ্রা আসলে বেশ কঠিন হয়ে উঠল ব্যবসার জন্য। কারণ, ধাতুর যা ওজন, সেই ওজনের মুদ্রা নিয়েই ব্যবসা করতে হত ব্যবসায়ীদের। তাই এবার প্রয়োজন পড়ল অত্যন্ত হাল্কা কিছুর। যার ভ্যালু প্রত্যেকের জন্যই সমান থাকবে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের এই ধাতব মুদ্রা বয়ে নিয়ে যাওয়ার হ্যাপা সামলাতে হবে না। আর যে কারণে চিনে চালু করা হল চামড়ার মুদ্রা। তাতে আবার আঁকা থাকত সুন্দর সব ছবি। কারণ, জালিয়াতি এখনকার মতন তখনও ছিল বেশ ভালো রকম। আর এভাবেই ধীরে ধীরে, নবম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে দেখা গেল, কাগজের নোট। সেটাও ঐ চিন থেকেই। জনপ্রিয়তা পেল। আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য করাটা আরও সহজ হয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও ছিল খুব গোলমেলে ব্যপার। মনে করা হয় কাগজের নোট জালিয়াতি করা সেই সময় এত বাড়তে শুরু করে যে তারা ধাতব মুদ্রা চালু করতে বাধ্য হয় চিন।
Modern History of Paper Note:
যাই হোক, এরপর কেটে গেল বেশ কয়েকশো বছর। ১৮১৬ সাল। ব্রিটেন বলল, ব্যাঙ্কে যত পরিমাণ সোনা থাকবে সেই মতই ছাপানো হবে কাগজের নোট। তার মানে কাগজের নোট এখন গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের বরাবর হয়ে গেল। এভাবেই প্রত্যেকটি দেশ গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের সমান কাগজের নোট ছাপাতে শুরু করল। কিন্তু এরপর আমেরিকায় দেখা গেল গ্রেট ডিপ্রেশন। কর্মহারা হচ্ছিলেন একের পর এক মানুষ। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘাড়ে চাপছিল ক্ষতির বোঝা। অবশেষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট সোনা এবং ডলারের সম্পর্কে ইতি টানলেন। ডলার ছাপানো শুরু হল। নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তৈরি করা হল ফেডেরাল রিজার্ভ। ফলে এখন শুধুই এটা কাগজের নোট হিসেবে থেকে গেল। যাকে বলা হয় ফিয়াট মানি। শুধু আমেরিকা বলে নয়। প্রতিটি দেশেই শুরু হল ফিয়াট মানির রমরমা। এরপর সময় পেরোল। পৃথিবীর আবহাওয়ায় এলো বদল। এখন কাগজের নোট ব্যবহার করা অনেকটা সোজা। চটজলদি নিয়ে যাওয়ার সুবিধে, ঝুটঝামেলাহীন লেনদেন। হাতে গোনার সুবিধেও রয়েছে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে টাকার এক ঐতিহাসিক জার্নির সাক্ষী থাকলাম আমরা। কিন্তু এখানেই যে শেষ নয়। এরপরেও আরও পাল্টেছে যুগ। এখন প্রতিদিনের ট্রানজাকশন হতে হবে কয়েক সেকেণ্ডে। মিটিয়ে ফেলতে হবে গোনাগুনির ঐতিহ্য। তাই কাগজের নোটের থেকে এখন বর্তমান প্রজন্ম এসে দাঁড়িয়েছে ডিজিটাল ট্রানজাকশনের ওপর। ব্যাঙ্কগুলোকেও এই গোনাগুনির হ্যাপা থেকে কিছুটা রেহাই পেল।
Conclusion:
আমরা প্রতিদিন আমাদের ওয়ালেট, ব্যাঙ্কে নিজেদের জমানো পুঁজি খরচ করি। এই হাত থেকে ঐ হাত। ঐ হাত থেকে সেই হাত। এভাবেই ঘুরতে থাকে টাকা। কিন্তু কোনদিন কি ভেবেছি যে সেই কোন প্রাচীনকাল থেকেই টাকা আসলে আমাদের সমাজব্যবস্থাকে একটা গতি দিয়েছে। বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে একটা স্মারক হিসেবে থেকে গিয়েছে সেই সুপ্রাচিনকাল থেকেই। ভেবে দেখুন তো, বিনিময়ের মাধ্যমটা হাজার হাজার বছরের পুরনো। সেই মাধ্যমের আবরণের শুধু পরিবর্তন হয়েছে। আজ টাকা ছাড়া সবই অচল। ইতিহাস যেমন থেমে থাকে না, টাকাও তেমনি আটকে থাকে না। জীবনপ্রবাহের সঙ্গে পাল্টে চলেছে মাত্র।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ