Science & Technology
আচ্ছা যদি বলি আমরা যা দেখি বা এই মূহুর্তে আমরা যা দেখছি তার একটিও বর্তমান নয় বরং অতীত, তাহলে কি অবাক হবেন? এটা খুবই সাধারণ একটা বিজ্ঞান। আলো প্রতিফলিত হয় বলেই আমাদের চোখে সব দৃশ্যমান হয়। আলো মানে, সূর্য থেকে পৃথিবীতে আসা আলো। প্রায় ১৪ কোটি কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছতে সময় নেয় ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড মতন। মানে, সূর্য যদি ধ্বংস হয় সেক্ষেত্রে আমরা বুঝতে পারব সূর্য ধ্বংস হওয়ার ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড পর। তার মানে আমরা আসলে যাকে বর্তমান বলছি, তা বর্তমান নয়। পুরোটাই অতীত। কিন্তু মানবজাতির জিজ্ঞাসু মন শুধু অতীতের এই সামান্য সময়কে আশ্রয় করেই এগোতে চায় না। খুঁজতে চায় ইতিহাস। সেই ইতিহাস যা মহাকাশের গ্রহ, নক্ষত্রের চেহারা তাদের সময়কালকে তুলে ধরবে। আমরা জানতে পারব পৃথিবী জন্মের রহস্য। এই ব্রহ্মাণ্ডের আদি রহস্যকে। সেই প্রচেষ্টা করে আসছেন বিজ্ঞানীরা। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আজ মহাকাশে পৌঁছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তৈরি করেছে এক নয়া নজির। এত দূর অতীতে ঝাঁপ দেওয়া সম্ভব? প্রশ্নটা মনের মধ্যে তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, ঐ মহাকাশ থেকে আমাদের জন্য জেমস ওয়েব যে ছবি পাঠিয়েছে তা একশো বা দুশো বছরের নয়। বরং ১৩৫০ কোটি বছর আগেকার। ভাবতে পারছেন? তখন কোথায় রাজনীতি, অর্থনীতি বা ধর্মীয় দলাদলি? যে প্রাচীন ইতিহাসের খোঁজ দিয়েছে এই জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ, তা বিস্ময় জাগানো ছাড়া আর কীই বা দিতে পারে? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে আমরা তুলে ধরব মহাবিশ্বের এই বিস্ময়কে। আলোচনা করব জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ নিয়ে। সঙ্গে বলব, কি করে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হল।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন বিশ্ববাসীর সামনে হোয়াইট হাউজে ১৩০০ কোটি বছরের পুরনো মহাবিশ্বের ছবি প্রকাশ করলেন, তখন সেটা আর শুধু মার্কিনী অবদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকল না। কারণ, বিজ্ঞানের অগ্রগতি তা সে যে দেশই করুক না-কেন, আসলে সেটা গোটা মানবজাতির স্বার্থে হয়ে থাকে। হ্যাঁ, এই অবদান যে দেশের বিজ্ঞানীরা করে থাকেন, তাঁদের জন্য অবশ্যই অভিনন্দন প্রাপ্য। এক্ষেত্রে যেমন নাসা। ১৯৯৬ থেকে ২০২২। আকাশ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল পেয়েছেন নাসার বিজ্ঞানীরা। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ তুলে ধরেছে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সির একটি রঙিন ছবি। গ্যালাক্সির এই অংশের নাম দেওয়া হয়েছে এসএমএসিএস০৭২৩। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মহাবিশ্বের প্রাচীনতম ছবিটি তুলে ধরেছে এই টেলিস্কোপ। অর্থাৎ বিজ্ঞান এগিয়ে চলেছে এই মহাবিশ্বের একেবারে শুরুর দিকে এগোনোর সঙ্গে। ছবিতে যে বিভিন্ন গ্যালাক্সি দেখা যাচ্ছে এবং সেই গ্যালাক্সির চারপাশে যে আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যাচ্ছে, সেটা ধরা পড়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে। কারণ এই আলো পৌঁছতে সময় লেগেছে কয়েক শো কোটি বছর। কিন্তু জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করল? তার জন্য নাসার বিজ্ঞানীরা কোন অভূতপূর্ব টেকনোলজি ব্যবহার করলেন? চলুন, তার আগে বরং জেনে নেওয়া যাক কেন এই টেলিস্কোপের নাম রাখা হল জেমস ওয়েব। কে ছিলেন তিনি?
জেমস ই ওয়েব বা জেমস ওয়েব। যিনি একদিকে ছিলেন একজন মার্কিন মুলুকের সরকারি কর্মকর্তা, তেমনই অন্যদিকে ছিলেন নাসার হর্তা-কর্তা-বিধাতা। সময়কাল ১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত। নাসার প্রধান দায়িত্বে থাকার সময় তিনি দু’জন রাষ্ট্রপতিকে পেয়েছিলেন। একজন কেনেডি এবং অন্যজন লিন্ডন জনসন। মনে করে দেখুন, ১৯৬৯ সালে প্রথম চাঁদের বুকে পা রাখে মানুষ। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তৈরি হয় এক নতুন অধ্যায়। কিন্তু তার প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেকদিন আগেই। অর্থাৎ, অ্যাপোলো অভিযানে তাঁর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাই হোক, নাসার এগিয়ে যাওয়ার পথে জেমস ওয়েবের ভূমিকা ছিল অসামান্য। আর যে কারণেই টেলিস্কোপের নাম রাখা হয় জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই টেলিস্কোপ তৈরির গুরুত্ব কিসের জন্য অনুভব করল নাসা?
নাসা এমন একটি টেলিস্কোপ তৈরির ভাবনাচিন্তা করেছিল, যার দুটো বৈজ্ঞানিক লক্ষ্য আছে বলে ধরা যেতে পারে। এক, ছায়াপথের জন্ম-বিবর্তনের ইতিহাস। দুই, গ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টির ইতিহাস সম্পর্কে জানা। এই টেলিস্কোপ তৈরির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এর আয়না। ১৮টি ষড়ভুজাকৃতির আয়না এখানে ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি আয়নার ব্যাস ১.৩ মিটার। এবং প্রত্যেকটি আয়নায় রয়েছে সোনার প্রলেপ। কারণ সোনা সবথেকে বেশি ইনফ্রারেড রে প্রতিফলন করতে পারে। এই ১৮টি আয়না একত্রে মৌচাকের আকৃতির একটি বৃহৎ শক্তিশালী আয়নায় পরিণত হয়েছে। এই টেলিস্কোপের ব্যাস ২১ ফুটের মতন। এছাড়াও বিজ্ঞানীরা এই টেলিস্কোপ তৈরি করতে যে ধরণের প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন, সেটা আর পূর্বে এভাবে কোনদিন ব্যবহার করা হয়নি। এই টেলিস্কোপের অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হল, টেলিস্কোপটিকে যত ইচ্ছা বড় করা সম্ভব। সর্বোচ্চ পরিমাণ আলো যাতে আপতিত হতে পারে। তার মানে বহু দূরের বস্তুও খুব ভালোভাবে দেখা সম্ভব হবে। এই টেলিস্কোপটি এমনভাবেই রাখতে হয়েছে যেন পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের কোন বাধা তার কাজে ব্যাঘাত না-ঘটাতে পারে।
শুধু ছায়াপথ বলেই নয়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বিভিন্ন গ্রহের আবহাওয়ার খুঁটিনাটি তথ্য তুলে দিতে সক্ষম। একইভাবে অন্যান্য গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা আছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখবে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। জেমস ওয়েব মহাবিশ্বের যে অংশের ছবি পাঠিয়েছে, সেখান থেকে আলো আসতে সময় লেগেছে প্রায় ৪৬০ কোটি বছর। ১৯৯৬ সালে প্রথম জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বানানোর পরিকল্পনা করে নাসা। সঙ্গ দেয় ১৭টি দেশ। আর এই টেলিস্কোপ তৈরিতে খরচ হয়েছে প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সবমিলিয়ে বলা যায়, জেমস ওয়েব মহাকাশ গবেষণায় দুর্দান্ত একটি ছাপ রেখেছে। বর্তমানে জেমস ওয়েব হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ। যাকে গেল বছর ডিসেম্বরে উৎক্ষেপণ করেছিল নাসা।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ