Science & Technology
বয়স মাত্র ৩০। আর ঐ বয়সেই তিনি সেই ভারতীয় যিনি জয়েন করেছিলেন রয়্যাল সোসাইটি অফ ম্যাথামেটিক্সে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি এস এল লোনির অ্যাডভান্সড ট্রিগোনোমেট্রিতে নিজের দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। আর ১৬ বছর বয়সে নিজের দক্ষতা দেখান ৫ হাজার থিওরেমে তৈরি জি এস কারের বই ‘আ সিনোপসিস অফ এলিমেন্টারি রেজাল্টস ইন পিওর অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্স’-এ। চিনতে পারছেন তিনি কে? ভুলে যাবেন না, তাঁর জন্মদিনেই পালন করা হয় ইন্ডিয়ান ম্যাথামেটিক্স ডে। তিনি শ্রীনিবাস রামানুজন। যার কদর ভারত সেভাবে করতেও পারল না। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোও সেভাবে মনে রাখতে পারেনি এই ম্যাথামেটিক্স জিনিয়াসকে। তাই অনেকেই তাঁকে চিনে উঠতে পারেন নি। একজন ফরগটেন জিনিয়াস বললেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। কিন্তু কেন? আসুন, আজ আমরা প্রতিবেদনে তুলে ধরব এই এক্সট্রা অরডিনারি জিনিয়াসের কিছু কথা। যার দেখানো পথেই আজ আমাদের কাছে খোলসা হচ্ছে স্ট্রিং থিওরির কনসেপ্ট।
অঙ্ক, অঙ্ক আর শুধু অঙ্ক। ছোট থেকে তিনি অঙ্ক ছাড়া আর কিছুই জানতেন না, কিছুই বুঝতেন না। শোনা যায়, খাবার খাওয়ার সময়েও তিনি শ্লেটে অঙ্ক কষতেন। সময়কালটা অনেকটাই পিছনে। ১৮৮৭ সালের একটু পর। ১৯০০ সাল নাগাদ। খেলাধুলা বা অন্যান্য বিষয়- কোন কিছুই রামানুজনকে অঙ্ক থেকে সরিয়ে রাখতে পারেনি। দিন রাত নিজে শুধু একের পর এক জটিল সমস্যার সমাধান করতেই ব্যস্ত থাকতেন। ১৭ বছর বয়সে যখন তিনি জি এস কারের বই হাতে পান, তখন রামানুজনের কাছে খুলে যায় এক অন্য পৃথিবী। উপপাদ্য, একের পর এক নতুন নতুন সূত্র। রামানুজন নিজেকে ডুবিয়ে রাখলেন শুধু অঙ্কের মধ্যেই। এই বইগুলো পড়তে পড়তেই তিনি প্রোব্যাবিলিটি, স্ট্যাটিসটিক্স, নম্বর থিওরি, ডেটা অ্যানালিসিস অর্থাৎ অয়লার-মাসশেরনি কনস্ট্যান্টের ভ্যালু ১৫ ডেসিমাল পর্যন্ত সল্ভ করতে পেরেছিলেন। এমনকি অঙ্কে তিনি যে মেধা দেখিয়েছেন, সেটা ইন্ডিয়ান ম্যাথামেটিকাল সোসাইটির ফাউন্ডার ভি রামাস্বামী আয়ার পর্যন্ত করতে পারেন নি। নিঃসন্দেহে রামানুজন গণিতের জন্যই হয়ত জন্মেছিলেন। অঙ্ক ছাড়া তিনি আর কিছুই ভাবতে পারতেন না। আর এটাই কিছুটা হলেও কাল হয়ে দাঁড়াল রামানুজনের জন্য। এফ এ পরীক্ষায় অঙ্ক ছাড়া প্রতিটা সাবজেক্টে ফেল করলেন। বন্ধ হল বৃত্তি। চুকল লেখাপড়ার পাঠ। ফিরে গেলেন নিজের গ্রামে। কিন্তু সেখানে গিয়েও ডুবে থাকলেন ইন্টিগ্রাল ম্যাথামেটিক্স, সিরিজের মতন ম্যাথামেটিকাল প্রবলেম সল্ভ করা নিয়ে। এরপর তিনি ভর্তি হলেন কলেজে। কিন্তু সেখানেও অঙ্ক ছাড়া আর কোন বিষয়েই পাশ করতে পারলেন না। ফলে কলেজের ডিগ্রি আর পাওয়া হল না। ডিগ্রি নেই মানে চাকরি নেই। চাকরি নেই মানে সংসার চালানোর মতন টাকাও নেই। কিন্তু যে অঙ্ক তাঁর কাছে শ্বাস-প্রশ্বাসের মতন ছিল, সেই অঙ্ক কি আদৌ তাঁকে কোন পথ দেখাতে পারল? দিতে পারল এক সুস্থ, নিশ্চিন্দির ভবিষ্যৎ? তখন ব্রিটিশ রাজত্ব চলছে। কে আর রামানুজনের মত কম কথা বলা একটি ছেলেকে গণিতবিদ্যা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ফান্ডিং করবে? অতএব, চাকরি। অঙ্কের জাদুগরি বিদ্যা কিছুটা কমিয়েই তিনি জয়েন করলেন মাদ্রাজ পোর্ট ট্রাস্টে। এক সামান্য কেরানির চাকরি নিলেন তিনি। এরই মধ্যে ১৯০৯ সালে তিনি বিয়ে সারেন মায়ের ইচ্ছায়।
পোর্ট ট্রাস্টে চাকরি করার সময় তাঁর কলিগ রামানুজনের গণিত প্রতিভা দেখে কিছুটা অবাক হন। এবং ‘অন দ্য ডিস্ট্রিবিউশন অফ প্রাইমস’ নামে একটি লেখা পাঠিয়ে দেন তৎকালীন বাঘা গণিতবিদ এইচ এফ বেকার, জি এইচ হার্ডি এবং ই ডব্লিউ হবসনের কাছে। রামানুজন আশা করেছিলেন, রয়্যাল সোসাইটি অফ ম্যাথামেটিক্সের এই তিন মেম্বার নিশ্চয়ই তাঁর ট্যালেন্টকে বুঝতে পারবেন। কিন্তু সেখানেও খেলেন ধাক্কা। কারণ এইচ এফ বেকার এবং ই ডব্লিউ হবসন রামানুজনের এই থিওরি পড়ার জন্য লেখাটা খুললেন না। ফেরত পাঠিয়ে দিলেন। আবারও নিজের যাবতীয় স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রামানুজন ভেবেছিলেন, হয়ত এবার তৃতীয়জনও তাঁকে নিরাশ করবেন। কিন্তু ম্যাজিক হল এখানেই। একদিন রামানুজনের কাছে চিঠি এলো জি এইচ হার্ডির থেকে। ইংল্যান্ডে আসতে বললেন রামানুজনকে। তার কারণ, রামানুজন হার্ডির থিওরি লজিকালি ভুল বলে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন। কিন্তু রামানুজনের থিওরেমে তিনি কি দেখেছিলেন? হার্ডি দেখলেন, অন্য দুই বিশ্ব বিখ্যাত ম্যাথামেটিশিয়ান্স অয়লার এবং গসের হাইপারজিওমেট্রিক সিরিজে রামানুজন গসের থেকে অনেক ভালো সল্ভ করেছিলেন। তাজ্জব বনে যান। ডেকে পাঠান রামানুজনকে। কিন্তু রামানুজন যখন ইংল্যান্ড পৌঁছলেন, তখন সেখানেও তাঁর ভাগ্য খুলল না। কারণ সাল ১৯১৪। শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। টালমাটাল বিশ্ব রাজনীতি। বোম আর বন্দুকের ধোঁয়ায় হারিয়ে গেল রামানুজনের স্বপ্ন। হারিয়ে গেলেন রামানুজন। কিন্তু এসবের মধ্যেও তিনি ম্যাথামেটিক্সকে এমন এক দিশা দেখালেন, যেটা ছাড়া আজকের স্ট্রিং থিওরি-কে দাঁড় করানো কিছুটা অসম্ভব ছিল। কারণ ডেভিড গ্রস যিনি স্ট্রিং থিওরির জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তিনি যে ইকুয়েশনের কথা বলেছিলেন তার নাম রামানুজন’স নম্বর ১৭২৯। কিন্তু ১৭২৯ কেন?
এখানেও রয়েছে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয়। অর্থাভাব, খাদ্যাভাবে জর্জরিত রামানুজন যখন শেষবারের জন্য হাসপাতালে ভর্তি হলেন এবং হার্ডি তাঁকে দেখতে গেলেন, তখন রামানুজন ট্যাক্সির নম্বর জানতে চেয়েছিলেন। হার্ডি বলেন, ট্যাক্সি নম্বর ১৭২৯। খুবই সাধারণ একটা নম্বর। কিন্তু রামানুজনের কাছে সেটাই অসাধারণ হয়ে উঠেছিল। তিনি বলেছিলেন, ১৭২৯ কে ১২ কিউব + ১ কিউব উপায়ে যেমন লেখা যেতে পারে তেমনি ১০ কিউব + ৯ কিউব উপায়েও লেখা যেতে পারে। মানে, ১৭২৯ এমনই ধনাত্মক সংখ্যা যাকে দুটো আলাদা নম্বর সিস্টেমে ফেলে কিউবের সমষ্টি করা যায়। আসলে ফ্রেঞ্চ ম্যাথামেটিশিয়ান পিয়ের দে ফারম্যাট বলেছিলেন, এক্স স্কোয়ার + ওয়াই স্কোয়ার = জেড স্কোয়ার এটা শুধু ২ এর পাওয়ারেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু রামানুজন বললেন একেবারে অন্য কথা। তিনি বলেন, হায়ার পাওয়ার থাকলেও সেটা সমভব। শুধু প্রয়োজন +১ অথবা -১। আর যে কারণেই এটা রামানুজন’স নম্বর ১৭২৯ হিসেবে খ্যাতি পেল।
আজ রামানুজনের সম্পর্কে পশ্চিমা দেশের গুটিকয়েক লোক ছাড়া তেমন কেউ জানেন না। ভারতের জন্য সেটাও যেমন দুর্ভাগ্যের, তেমনি ভারত নিজেও তো রামানুজনকে নিয়ে তেমনভাবে মেতে থাকতে পারল না। আজ ইন্ডিয়ান ম্যাথামেটিক্স ডে পালন করা হয় রামানুজনের জন্মদিনে। কিন্তু ঐ টুকুই। তাই আমাদেরও কর্তব্য, প্রতিটি ছাত্রছাত্রী শুধু নয়। দেশে বিদেশের প্রত্যেকটি মানুষের কাছে এই জিনিয়াস সম্পর্কে পরিচয় করানো। মাত্র ৩২ বছরের জীবনকালে তিনি যা করেছেন, এমন কজন জিনিয়াস আসলে করতে পেরেছিলেন?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ