Science & Technology
মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকের পালা এবার শেষ। বদলে দশম এবং দ্বাদশের পড়ুয়াদের জন্য থাকছে বছরে দুটো বোর্ড এক্সাম দেওয়ার সুযোগ। পড়ুয়াদের চাপ কমিয়ে উচ্চমানের শিক্ষা প্রদান করে ভারতকে গ্লোবাল নলেজ সুপারপাওয়ারে পরিণত করতে ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০-তে শিলমোহর দিল ভারতের মন্ত্রিসভা। কী এই ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০? আর কেনই বা তা কার্যকর করার এত হিড়িক উঠলো,
*জীবনে প্রথম হওয়াটাই কি সব?
মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিকে যারা ফার্স্ট ডিভিশন পাননি, তাদের কি কেরিয়ার শেষ?
কেমন হত পরীক্ষাহীন একটা শিক্ষা ব্যবস্থার ছবিটা?*
ভারতীয় উপমহাদেশের কথাই ভাবুন না। যেখানকার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল মেইনলি গুরু বা শিক্ষক নির্ভর। যেখানে শিক্ষা ছিল মূলত পেশা নির্ভর। কিন্তু আধুনিক সময়ে এসে ভারতের এডুকেশন সিস্টেমে এসেছে আমূল পরিবর্তন। আর সবচেয়ে আগে টার্গেট করা হয়েছে পরীক্ষা পদ্ধতিকে। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে যতরকমের এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে, ততরকমের এক্সপেরিমেন্ট আর অন্য কথাও হয়েছে কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অর্থাৎ, শিক্ষার মাপকাঠি নির্ধারণ করতে পরীক্ষা পদ্ধতি হয়েছে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আর আজকের এই আলোচনা, শিক্ষাক্ষেত্রে এই পরীক্ষা পদ্ধতির ভূমিকা নিয়ে। বিশেষ করে, আমরা বোঝার চেষ্টা করব, ভারতের এডুকেশন সিস্টেমে এই এভলিউশন কতটা কার্যকর।
ইতিহাস বলছে, পরীক্ষা একটা প্রাথমিক ধারণা হিসেবে প্রাচীন চিনে প্রথম শুরু হয়। উদ্দেশ্য ছিল, রাজ্য পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে লোক নির্ধারণ করা। মাইটি ব্রিটিশদের হাত ধরে সেই পরীক্ষাই হয়ে ওঠে আজকের এডুকেশন সিস্টেমের কী-ফ্যাক্টর। পাবলিক সেক্টর বলুন বা অ্যাকাডেমিক সেক্টর, পরীক্ষার্থীদের নানা সময়ে নানান পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। আর দিন শেষে পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন, মা-বাবা এমনকি শিক্ষকরাও। একবার সত্যি করে ভেবে বলুন তো, পরীক্ষার ফলাফল কি একজন স্টুডেন্টের সামগ্রিক শিক্ষার মূল্যায়ন করতে পারে? একজন স্টুডেন্ট হিসেবে আপনি যা শিখলেন, একজন টিচার হিসেবে আপনি যা শেখালেন কিংবা ধরুন একজন অভিভাবক হিসেবে আপনি যে সামাজিক, মানসিক বা আর্থিক ত্যাগ শিকার করলেন, একজামিনেশন নামক মানদণ্ডে তার মূল্যায়ন কি সত্যি সম্ভব?
পাশের বাড়ির বন্ধুর থেকে কম নম্বর পাওয়ার অপরাধে আজও যখন একজন স্টুডেন্টকে উঠতে বসতে কথা শুনতে হয়, তখন এটা জানলে আপনি হয়তো অবাক হতে পারেন যে, উন্নত বিশ্বের অনেক দেশেই শিশুদের জন্য কোন পরীক্ষা ব্যবস্থাই নেই। বরং ফরমেটিভ অ্যাসেসমেন্টকে তারা বেশি জোর দেয়। এমনকি হাই স্কুলের স্টুডেন্টদের জন্যও বছর শেষে রয়েছে মাত্র একটি পরীক্ষা। ২০১৯ সাল নাগাদ সিঙ্গাপুরেও প্রাইমারি এডুকেশন সিস্টেম থেকে পরীক্ষা পদ্ধতিকে সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের জন্যে না আছে র্যাঙ্কিং, না আছে মার্কিং, না আছে গ্রেডিং। রয়েছে ডিসকাশন, ক্যুইজ আর হোমওয়ার্ক। মানে নো চাপ, ওনলি ফান। এবার ফিরে আসা যাক ভারতের এডুকেশন সিস্টেমের কাছে। ইন্ডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম বরাবরই একটা বড়সড় তর্কমঞ্চ। এ, ওকে দোষ দেয়- তো সে তাকে। আর এই গোটা বিষয়টা আরও স্ট্রং হয়েছে গত কয়েক বছরে। বদলেছে পরীক্ষা পদ্ধতি, বদলেছে কোশ্চেন প্যাটার্ন। যা আজও বেশিরভাগ শিক্ষক ঠিকমত বুঝেই উঠতে পারেননি। ফলে এডুকেশন সিস্টেমে নেমেছে একটা বড়সড় ধস।
সাল ১৯৫৬। শিকাগো ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক বেঞ্জামিন ব্লুম এডুকেশন সিস্টেমকে তিনটি ডোমেনে ভাগ করেন। Cognitive, Mental আর Psychiatric Field। স্টুডেন্টরা কী জ্ঞান অর্জন করছে সেটা মেইনলি পরিমাপ করে কগ্নিটিভ ডোমেন। শেখার ফলে স্টুডেন্টদের মধ্যে কোনরকম মেন্টাল ডেভলপমেন্ট হচ্ছে কি না সেটা মেন্টাল ডোমেন থেকে দেখা হয়। মূলত পরীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয়ে মূল্যায়ন করা গেলেও পর্যবেক্ষণটাই আসল। আর এখানেই ধাক্কা খেয়েছে ভারতের এডুকেশন সিস্টেম। ধর্ম আর বিজ্ঞানের মারামারির কারণে যেটা আরও বেশি করে স্পষ্ট হচ্ছে সকলের মধ্যে। কোন কিছু শেখার পর সেটার অ্যাপ্লিকেশন করাটা সবচেয়ে বেশি ইম্পরট্যান্ট, যেটা সাইক্রিয়াটিক ডোমেনে পড়ছে। একজন শিক্ষার্থীর কতটা মানসিক বিকাশ হল সেটা আমরা যাচাই করি শুধুমাত্র কগ্নিটিভ ডোমেনের উপর ভিত্তি করে। তাও আবার আংশিক। Creating, Evaluating, Analyzing, Applying, Understanding আর Remembering- ব্লুমস ট্যাক্সনমির কগ্নিটিভ ডোমেনের ছটি চ্যাপ্টার। কিন্তু বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা এই ব্লুমস ট্যাক্সনমির বারোটা বাজিয়ে ছটি চ্যাপ্টারকে চারটি চ্যাপ্টারে ভাগ করে ফেলেছেন। আর ঠিক এই কারণেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে আধুনিক এডুকেশন সিস্টেমের পরীক্ষাপদ্ধতি।
তবে এত কিছুর মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০, যা আগামী বছর থেকেই চালু হতে চলেছে। পরীক্ষা পদ্ধতিকে সহজ করে কোচিং কালচারকে এলিমিনেট করতে এই পলিসিকে ছাড়পত্র দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। কেমন হবে এই পলিসির পরিকাঠামো? চলুন জেনে নেওয়া যাক। ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি ২০২০ অনুযায়ী, এবার থেকে পড়ুয়ারা বছরে দুটো বোর্ড এক্সাম দিতে পারবেন। একটায় থাকবে অবজেক্টিভ টাইপ প্রশ্ন আর অন্যটায় ডেসক্রিপটিভ টাইপ প্রশ্ন। বছরে দুবার স্টুডেন্টদের উচ্চমানের কমন অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট এবং বিভিন্ন বিষয়ের উপর কমন স্পেশালাইজড টেস্ট নেবে ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি বা এনটিএ। পড়ুয়াদের মাথার উপর থেকে পড়াশুনোর চাপ কমাতেই এই সিদ্ধান্ত। আপনারা সকলেই জানেন, ইন্ডিয়ান এডুকেশন সিস্টেম ছিল ১০+২ ভিত্তিক। এবার সেটাই রিপ্লেস করে ফলো করা হবে ৫+৩+৩+৪ পলিসি।
প্লেট
ফাউন্ডেশনাল স্টেজ (৫ বছর)
প্রি-স্কুল – ক্লাস ২ এর শিক্ষার্থীদের এই স্টেজে ফেলা হয়েছে। যেখানে অ্যাক্টিভিটি বেসড বা প্লে-বেসড এডুকেশন সিস্টেমে তাদের শেখানো হবে এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভলপমেন্টের দিকে ফোকাস করবেন শিক্ষকরা।
প্রিপারেটরি স্টেজ (৩ বছর)
ক্লাস ৩ থেকে ৫ এর স্টুডেন্টরা এই স্টেজে পড়ছেন। ল্যাঙ্গুয়েজ ডেভলপমেন্টের পাশাপাশি স্টুডেন্টদের ক্লাসরুম ইন্টার্যাকশন ও সংখ্যাগত দক্ষতার দিকে নজর দেবেন শিক্ষকরা।
মিডল স্টেজ(৩ বছর)
ক্লাস ৬ থেকে ক্লাস ৮ এর পড়ুয়ারা এই স্টেজে পৌঁছে সায়েন্স, ম্যাথস, সোশ্যাল সায়েন্স, আর্টস এবং হিউমানিটিস এর উপরে এক্সপেরিমেন্টাল এডুকেশন পাবেন।
সেকন্ডারি স্টেজ (৪ বছর)
এডুকেশন সিস্টেমের এই স্টেজটি সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট। কারণ এক্ষেত্রে পড়ুয়াদের একটা সাবজেক্টের আরও গভীরে নিয়ে যাওয়া হবে। ক্লাস ৯ -১২ এর স্টুডেন্টরা এই স্টেজের অন্তর্ভুক্ত।
নতুন এই এডুকেশন পলিসি, শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বড় ছাপ ফেলবে বলে আশা রাখছেন শিক্ষার গবেষকরা। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে এই পরিবর্তন আনাটা আরও আগেই প্রয়োজন ছিল। তবে এক্ষেত্রে যেহেতু স্কুল বেসড এডুকেশনের উপর মূল্যায়ন করা হচ্ছে তাই শিক্ষকদের অনেক বেশি যোগ্য এবং স্বাধীন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ যোগ্য শিক্ষক ছাড়া এই পলিসি ফলো করা কার্যত অসম্ভব। আর সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের সংখ্যা এবং যোগ্যতা দুটোই বাড়াতে হবে। কিন্তু এই পলিসির সুফল পেতে যা কাঠখড় পোড়াতে হবে কিংবা তারপরেও সঠিকভাবে সবটা ব্যালেন্স করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েই গেল। আপনাদের কী মনে হয়, এই নতুন পলিসি ভারতের এডুকেশন সিস্টেমকে মজবুত করতে কতটা কার্যকর হবে?
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ