Science & Technology
ভিয়েনা ১৯০৬। এই শহরের এক চিত্রশিল্পী একটি মেয়ের প্রেমে পড়লেন। মেয়েটির পরিবার বেশ বড়লোক। এদিকে ছেলেটি গরিব। কিন্তু প্রেম কি আর টাকা-পয়সার হিসেব কষে হয়? অতএব ছেলেটি প্রতিদিন মেয়েটিকে চিঠি পাঠাতে শুরু করল তার পোষা কুকুরের মাধ্যমে। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেল। কন্যার বড়লোক বাপ এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারলেন না এবং কুকুরটিকে খুন করলেন। প্রিয় পোষ্য মারা যাওয়ায় ছেলেটির মন ভেঙে যায় এবং ছেলেটি যোগ দেয় সেনাবাহিনীতে। ১৯১৮ সালে এক ব্রিটিশ সেনার হাতে সেই ছেলেটি ধরা পড়ে। ছেলেটির ওপর ঐ ব্রিটিশ সেনা খুব অত্যাচার চালায় এবং হত্যা করারও ভাবনা-চিন্তা করে। কিন্তু শেষমেশ তাঁকে হত্যা না-করে ছেড়ে দেয় ঐ ব্রিটিশ সেনা। সেই ছেলেটি কে ছিল জানেন? পরবর্তীকালের এক ভয়ঙ্কর শাসক অ্যাডলফ হিটলার। যার নির্দেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ৬৩ লক্ষ ইহুদীর। অনেকেই বলেন, সেই ইহুদি পরিবার যদি হিটলারের সঙ্গে সেদিন ঐ ব্যবহার না-করত, তাহলে হয়ত হিটলার আর স্বৈরাচারী হিটলার হয়ে উঠতেন না। থেকে যেতেন এক চিত্রশিল্পী হিসেবে। তাঁর মধ্যে জেগে উঠত না ইহুদি বিদ্বেষ। পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হত অন্যরকমভাবে।
আর একটা উদাহরণ দিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন পাইলটরা ভাবলেন জাপানের শহর কুরোকুতে পারমাণবিক বোমা ফেলবেন। কারণ কুরোকু শহরেই ছিল জাপানের এক বড় অস্ত্রাগার। কিন্তু মার্কিনী পাইলটরা যখন কুরোকু শহরে পৌঁছলেন, তখন কুরোকু শহর ছিল মেঘে ঢাকা। একবার নয়, তিন তিনবার তাঁরা কুরোকু শহরে বোমা ফেলার চেষ্টা করলেন। কিন্তু মেঘ এতটাই ছিল যে তাকে ভেদ করে ঐ অস্ত্র ঘাঁটি দেখা সম্ভব হল না মার্কিনী পাইলটদের। আর যে কারণে তাঁরা বোমা ফেললেন নাগাসাকিতে। অনেকেই বলেন, ঐ মেঘ থাকার কারণেই বেঁচে গেল কুরোকু। কিন্তু ধ্বংস হয়ে গেল নাগাসাকি। যে’দুটো উদাহরণ দিলাম, এই দুটো উদাহরণ একটু ভালো করে দেখলে বুঝতে পারবেন যে, এই দুটোর পরিণতি হয়েছিল বিধ্বংসী এবং ভয়াবহ। কিন্তু এমন ভয়াবহ পরিণাম ঘটার পিছনেই কাজ করেছে ছোট ছোট কিছু কারণ। মানে, ছোট একটা কারণের জন্য তার পরিণাম হয়ে উঠতে পারে ভয়াবহ। মানে অ্যামাজনের জঙ্গলে যদি প্রজাপতি ডানা ঝাপ্টায়, তাহলে টেক্সাসে দেখা দিতে পারে ঘূর্ণিঝড়। কথাটা অবিশ্বাস্য ঠেকলেও, বিজ্ঞানের ভাষায় এটাই বাটারফ্লাই এফেক্ট। আসুন, আজ এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করাই, হোয়াট ইজ বাটারফ্লাই এফেক্ট।
বাটারফ্লাই এফেক্টের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটান গণিতবিদ এবং আবহাওয়াবিদ এডওয়ার্ড লরেঞ্জ। তিনি একটি বিখ্যাত তত্ত্ব তুলে ধরেছিলেন যার নাম ‘থিওরি অফ কেওস’। বা বাংলায় যাকে বলা যায় বিশৃঙ্খলা তত্ত্ব। তিনি বলেন, বিশ্বের যে কোন তরঙ্গের সামান্য পরিবর্তন হলে সেটা অন্যান্য তরঙ্গকেও ভালোরকম প্রভাবিত করতে পারে। আর এটাকেই তিনি নাম দিয়েছেন বাটারফ্লাই এফেক্ট। কিন্তু কিভাবে বাটারফ্লাই এফেক্টের ধারণা তিনি পেলেন? এডওয়ার্ড লরেঞ্জ তখন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির আবহাওয়া ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক। সেই সময় আবহাওয়া নিয়ে ঠিকঠাক পূর্বাভাস দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং একটা কাজ ছিল। তাই নতুন একটি মডেল নিয়ে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করেন। সেদিন তিনি গাণিতিক পদ্ধতিতে কাজ করার জন্য দশমিকের পরে ছয়টি সংখ্যার পরিবর্তে তিনটি সংখ্যাকে ব্যবহার করেন। কিন্তু দেখা যায়, দশমিকের পর ঐ সামান্য কয়েকটি সংখ্যাকে বাদ দিতেই ফলাফলে বিস্তর পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন তিনি। এই পরিবর্তন আবহাওয়াতে বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারে বলেই মনে করেন তিনি। এভাবে যতবারই লরেঞ্জ মানের হেরফের করতে লাগলেন, প্রতিবারই পেতে থাকলেন বিভিন্ন ফলাফল। আর সেগুলোকে গ্রাফে বসালে অনেকটা প্রজাপতির ডানার মতন দেখতে হচ্ছে। যে কারণে এর নাম বাটারফ্লাই এফেক্ট বলে মনে করেন অনেকেই।
সাধারণত বিজ্ঞানের শাখা একটা সরলরৈখিক গতিতে চলে। সেটা হয় গণিতনির্ভর এবং নির্দিষ্ট কিছু নিয়মনির্ভর। কারণ এই ধরণের বিজ্ঞানের শাখায় যে মান পাওয়া সম্ভব সেটা সলভ করে বার করা সম্ভব। কিন্তু বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে এমনটা কিছুই হয়না। বরং যে সকল ঘটনার নির্দিষ্ট কোন ভবিষ্যদ্বাণী বা পূর্বাভাস করা সম্ভব নয়, সেগুলোকেই ফেলা হয় বিশৃঙ্খলা তত্ত্বে। এডওয়ার্ড লরেঞ্জ বাটারফ্লাই এফেক্টের মাধ্যমে প্রজাপতির ডানা ঝাপটানোর উদাহরণ টেনে সত্যিই যে ঘূর্ণিঝড় ঘটা সম্ভব এমন কিছু বোঝাতে চাননি। তিনি আসলে বলতে চেয়েছিলেন, কোন এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা দিনের শেষে এক বড় ভয়াবহ এফেক্ট তৈরি করতে পারে। শেষ করব আরেকটি উদাহরণ দিয়ে।
আমরা সকলেই চেরনোবিল বিপর্যয়ের কথা জানি। যে কারণে আজ গোটা শহরটাই কার্যত এক ভৌতিক শহরে পরিণত হয়েছে। জানা যায়, চেরনোবিল বিপর্যয়ের পিছনে কাজ করেছে পারমাণবিক কেন্দ্রের কিছু অপারেটরদের সাময়িক ভুল। পারমাণবিক কেন্দ্রের ৪ নম্বর চুল্লিতে অপারেটররা একটি পরীক্ষা করবেন বলে ঠিক করেন। তাই মেন পাওয়ার অফ করে তাঁরা অবশিষ্ট ৭ শতাংশ শক্তিকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন চুল্লি চালানোর জন্য। তারপরেই এক সামান্য ভুলের জন্য ঘটে এমন ভয়াবহ পরিণতি। আমরা প্রতিদিনের রুটিন লাইফের কথা ভেবে দেখুন তো। এমনকি পৃথিবীর ইতিহাসের দিকেও লক্ষ্য করুন, দেখবেন কোনটা ভুল আর কোনটা ঠিক- এইসবের মধ্যে পড়েই পাল্টে যাচ্ছে পরিণতি। যা চেয়েছিলেন, তার প্রভাব একেবারে পাল্টে যাওয়ার কারণেই আজ তাকেও কি বাটারফ্লাই এফেক্ট বলা সম্ভব নয়?
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ