Science & Technology
পৃথিবীর প্রথম মডার্ন ইউনিভার্সিটি বলা হয় ইতালির বোলগনা ইউনিভার্সিটিকে। সেটা প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল খ্রিষ্টীয় ১০-১১ শতকে। তারপর আসে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির নাম, তারপর আসে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির নাম। যদি আপনি গুগল সার্চ করে পৃথিবীর দশটি প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম খুঁজতে যান, তাহলেও ভারতের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পাবেন কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু আপনি একবার ভেবে দেখুন তো, যে তিনটি বিশ্ববিখ্যাত ইউনিভার্সিটির নাম বললাম, তারও ৭০০ বছর আগে এই প্রাচীন ভারতবর্ষে এমন এক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল যাকে শুধু ভারতবর্ষে পড়ুয়ারাই নয়, তৎকালীন গোটা বিশ্বের পড়ুয়ারা সমীহ করত। সেখানে পড়াশোনার জন্য আসত তিব্বত, চিন, জাপান, কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে কত কত শিক্ষার্থী। জানা যায়, শূন্যের আবিষ্কর্তা আর্যভট্ট ছিলেন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম অধ্যক্ষ। তৎকালীন ভারতবর্ষের জ্ঞানপীঠ ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়- নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। বছর, কাল এবং যুগের হাওয়া গায়ে মেখে আজ যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু উজ্জ্বল ইতিহাসটুকুই থেকে গেছে ইতিহাসের পাতায়। আসুন বন্ধুরা, আজকের প্রতিবেদনে কথা বলি প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞানপীঠ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে। সঙ্গে জেনে নেব, কিভাবে গোটা বিশ্বে সমাদৃত হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হল এবং হারিয়ে ফেলল তার গৌরব।
ইতিহাস থেকে জানা যাচ্ছে, প্রায় ১০ কিমি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হাতে গড়ে ওঠা পৃথিবীর অন্যতম সুপ্রাচীন এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যতটা বলা যায়, সেটাই যেন কম হয়ে যায়। তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, উদন্তপুর, বল্লভির মত জায়গায় ছিল বহু বৌদ্ধ মহাবিহার। এগুলি ছিল একইসঙ্গে শিক্ষার আঁতুড়ঘর। তবু এদের মধ্যে নালন্দা মহাবিহার ছিল সবচেয়ে ওপরে। খ্রিস্টীয় পঞ্চম, ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি গড়ে ওঠে বর্তমানে যা বিহার তারই প্রাচীন মগধে। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা পায় আনুমানিক ৪২৭ খ্রিষ্টাব্দে। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যাবে, সম্রাট কুমারগুপ্তের সময় থেকেই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। দেশ, বিদেশ থেকে বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা এখানে আসতেন পড়াশোনার জন্য। সেই সময় নাকি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার মতন। প্রতিদিন একশোর ওপর ক্লাস করানো হত বিভিন্ন বিষয়ে। দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, ব্যকরণ কিই না পড়ানো হত এখানে। ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে চৈনিক পরিব্রাজক জিউএনসাং নালন্দায় পড়াশোনার জন্য উপস্থিত হন। তারপর নালন্দা থেকে ৬৫০-র ওপর মূল্যবান পুঁথি নিয়ে যান চিনে। তাঁর ভ্রমণবৃত্তান্তে নালন্দার নাম রয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। তাঁর বৃত্তান্ত থেকেই জানা যায়, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক কতটা বিস্তৃত ছিল। যেখানে উল্লেখ রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল লাইব্রেরির কথা। প্রায় দেড় হাজার শিক্ষকের দেখানো পথেই সেইসময় নালন্দা মহাবিহার হয়ে উঠেছিল জ্ঞানকেন্দ্র। জানা যায়, সেই সময় এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ ছিল খুব কঠিন। কারণ কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করলে তবেই নালন্দায় পড়ার সুযোগ পেতেন পড়ুয়ারা। প্রতিটি বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষক ছিলেন। দূর দেশ থেকে আসা পড়ুয়াদের জন্য ছিল হোস্টেলের ব্যবস্থা। জানা যায়, এই বিশ্ববিদ্যালয় পুরোটাই চল রাজার আনুকূল্যে। পড়ুয়াদের পড়াশোনা করানো হত বিনা পয়সায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এতটাই কঠিন এবং উৎকর্ষ ছিল যে, পক্ষপাতিত্বের সুযোগ পেতেন না রাজপরিবারের কোন পড়ুয়াও। বরং দেশ-বিদেশ থেকে আসা পড়ুয়াদের জন্য দুধ, ঘি, চালের মতন নানা খাদ্য আসত প্রায় ২০০টি গ্রাম থেকে। মনে করা হয়, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ছিল লক্ষাধিক বই। উপনিষদের আসল পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ, প্রজ্ঞাপারমিতা সবই ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রাচীন ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থার আকাশে ধ্রুবতারার মতন জ্বলজ্বল করছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। যে তার গৌরব ধরে রাখতে পেরেছিল ১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দে। কারণ তারপরেই কার্যত ধ্বংস হয়ে যায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তুর্কি যোদ্ধা বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে। তারও একটা ইতিহাস আছে।
মনে করা হয়, বখতিয়ার খিলজি যখন উত্তর ভারতে হামলা চালাচ্ছেন, সেই সময় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন। যত দিন যায়, ততই খিলজির অসুখ কমার পরিবর্তে বাড়তে থাকে। সেই সময় তাঁর এক শুভাকাঙ্ক্ষী জানান, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ুর্বেদ প্রধান রাহুল শীলভদ্রের কথা। খিলজি প্রথমে রাজি না-হলেও পরে কিছুটা বাধ্য হয়েই তাঁকে ডেকে পাঠান। তিনি আসেন এবং খিলজির অসুখ সারিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু খিলজি একটা বদখেয়ালি শর্ত দিয়ে বসেন। তিনি বলেন, কোনরকম পুজো বা আয়ুর্বেদিক ওষুধ তিনি খাবেন না। তাতেও রাজি হন রাহুল শীলভদ্র। এর কয়েকদিন পর তিনি কোরান নিয়ে আসেন এবং বখতিয়ার খিলজিকে দিনে দুবার পাঠ করে কোরান পড়তে বলেন। দেখা গেল, অবিশ্বাস্যভাবে খিলজি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তিনি জানতে চান এই সুস্থ হয়ে ওঠার আসল কারণ কি? রাহুল শীলভদ্র জানান, তিনি কোরানের পাতাতে ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তারই গুণে সেরে উঠেছেন খিলজি। তুর্কি যোদ্ধা বুঝতে পারেন, ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্র কতদূর এগিয়েছিল। আর সেটাই যেন তাঁকে ঈর্ষা এবং রাগের আগুনে অন্ধ করে দিল। জানা যায়, হাজার হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষু সহ লক্ষাধিক বই সব পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিলেন তিনি। প্রায় তিন মাস ধরে নালন্দার পাঠাগার শুধু জ্বলছিল আর পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল অমূল্য, প্রাচীন সব বই। বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুরা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্যত্র।
ইতিহাসবিদরা বলছেন, নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস হবার পর থেকেই ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম কার্যত বিপন্ন হতে শুরু করে। এমনকি বুদ্ধকে নিয়ে যে উৎকর্ষের সঙ্গে চর্চা করা হত, সেটাও কমতে শুরু করে। ১৮১১ সালে ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন প্রথম নালন্দার ধ্বংসাবশেষ লক্ষ্য করেন। এরপর কানিংহাম ১৮৭২ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের খননের কাজ শুরু করেন। তারপর ১৯১৫ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত এই খননের কাজ ভালোভাবে চলে। তারপর ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৪। সেই সময় এই নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ধার হয় বহু বুদ্ধ মূর্তি। বেশ কিছু মূল্যবান পুঁথি সেই সময় নিয়ে যাওয়া হয় তিব্বতে। তারপর তিব্বতি ভাষাতেও অনুবাদ করা হয় এই পুঁথিগুলো। যদিও বহু কাঠখড় পোড়ানর পর আজ আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ভাবুন তো, শিক্ষাক্ষেত্রের যে উৎকর্ষতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন সুপণ্ডিত শিক্ষকদের হাত ধরে খ্যাতির চুড়ায় পৌঁছেছিল, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে ভারতের প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা কতটা ধাক্কা খেতে পারে। যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গায়ে তুর্কি যোদ্ধা খিলজির রক্তচক্ষু না-পড়ত, তাহলে হয়ত ভারতবর্ষের শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিবেদনটি আজকের মতন এখানেই শেষ করছি।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ