Science & Technology
বলা হয়, ইংরেজ যখন ভারত থেকে বিদায় নেয় ততদিনে ৪৫ ট্রিলিয়ন ডলার তারা নিয়ে যায় নিজেদের সঙ্গে। সবদিক থেকে উৎকর্ষ একটি দেশকে কিভাবে ফকির বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায়, সেটা ব্রিটিশরা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শুধুই কি ইংরেজ সাহেবদের সময়কালেই ভারত একেবারে সব হারানোর দেশ হয়ে গেছিল? আমরা সবাই জানি, ব্রিটিশ আসার আগে থেকে বহুবার বিদেশি শক্তির আক্রমণ হয়েছে ভারতে। তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, দেশের সবথেকে বড় মন্দিরগুলো। তাদের মধ্যে কিছু মন্দির ধ্বংস হয়ে ধন সম্পদ হারিয়েও ফের নিজের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছে, কিছু মন্দিরে বাইরের আক্রমণ কোন প্রভাব ফেলতেই পারেনি। আর কিছু মন্দিরে এখনো যা সম্পত্তি রয়ে গিয়েছে, তার পরিণাম চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে যে-কারুর। আসুন, আজ নজর দেওয়া যাক ইতিহাসের পাতায়। আজকের প্রতিবেদনে তুলে ধরব এমন কয়েকটি মন্দিরের ইতিহাস যা রয়ে গিয়েছে বিশ্বের ধনীতম মন্দিরের তালিকায়।
ধর্ম, অধ্যাত্মবাদ এবং বিশ্বাসের জোরালো কম্বিনেশন না-থাকলে ভারতের সংস্কৃতি কোনদিনই এতটা মূল্যবান হয়ে উঠতে পারত না। আজও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির দুর্দান্ত সাফল্যকে হার মানিয়ে দিতে পারে বিশ্বাস। কারণ বিশ্বাসের ওপর ভর করেই হাজার হাজার বছর আগে যে মেধা এবং পরিশ্রম ব্যবহার করা হয়েছিল, তাকে নষ্ট করতে পারে কে? তাই হাজার চেষ্টা করা হয়েছে তবু বারবার নিজেকে দাঁড় করিয়েছে এমনই একটি মন্দির- গুজরাতের সোমনাথ মন্দির। এই মন্দির ধূলিস্যাৎ করার জন্য আক্রমণ শানানো হয়েছিল ১৭ বার। আক্রমণ চালিয়েছিলেন মাহমুদ গজনি। মন্দির ধ্বংস করা ওর একটা ট্র্যাডিশন ছিল। যে কারণে ওর একটা ছদ্মনাম দেওয়া হয়েছে- আইডল ব্রেকার। জানা যায়, মাহমুদ এই মন্দির থেকে সোনা এবং রুপোর মূর্তি চুরি করে নিয়েছিল। একইসঙ্গে মূল্যবান রুবি লুটপাট করে নিয়ে চলে যায়। মনে করা হয়, হাজার বছর আগে যখন এই মন্দিরে প্রথম লুট চালানো হয়েছিল তখন সেই লুট করা সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২০ মিলিয়ন দিনার বা ৪৮০ কোটি টাকার সম্পদ। খেয়াল রাখবেন, এটা শুধু প্রথম আক্রমণের সময়। এরপরেও আরও ১৬ বার এই মন্দিরে হামলা চালায় মাহমুদ গজনি। এবং মন্দিরের বিপুল সম্পত্তি লুটের মধ্যে ছিল ৫টি সোনার মূর্তি। যে মূর্তির চোখে ছিল রুবির মত পাথর। আর একেকটা রুবির মূল্য ছিল প্রায় ৫০ হাজার দিনার!
আশা করি বুঝতে পারছেন যে, একটি মন্দির থেকে যে পরিমাণ সম্পদ খোয়া গেছে, সেই সম্পদের ভ্যালুয়েশন কত হতে পারে? তার মানে কত সম্পদ থাকার সম্ভাবনা ছিল গুজরাতের সোমনাথ মন্দিরে। গুজরাতের সোমনাথ মন্দির ছাড়াও আরেকটি যে মন্দিরের কথা বলতে পারি, তার নাম হল শ্রীপদ্মনাভস্বামী মন্দির। কেরালার থিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত এই মন্দিরের উল্লেখ রয়েছে বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ, ভগবদপুরাণ এমনকি মহাভারতেও। এই মন্দিরের ভেতর রয়েছে ৬টি দরজা। তার মধ্যে খোলা হয় ৫টি। জানা যায়, এই সকল দরজার পিছনে রয়েছে প্রাচীন সম্পদ, একের পর এক ব্যাগ ভর্তি সোনা আরও কত কী! মনে করা হয়, একেকটি সোনা ভর্তি ব্যাগের ওজন দাঁড়াতে পারে ৮০০ কেজিতে। এর মধ্যে একটি ব্যাগ যদি বের করা হয় আর এখনকার সোনার দামে বিচার করা হয়, তাহলে অঙ্কটা দাঁড়াতে পারে ৪০০ কোটিতে! এই মন্দিরে যা সম্পত্তি রয়েছে তার ভ্যালু প্রায় ১৭ বিলিয়ন ডলার। এছাড়া এই সকল সম্পদের উপরে যে নকশা কাটা হয়েছে, সেই সকল কারুকাজে জন্য সম্পদের ভ্যালু আরও এক ধাক্কায় বাড়তে পারে ১০ গুণ! মানে ১৭০ বিলিয়ন ডলার! এখানে কিন্তু ঐ ছ’নম্বর বন্ধ দরজার কথা বলা হয়নি। মনে করা হয়, ঐ দরজার পিছনে যে সম্পত্তি রয়েছে সেটা এই ৫টি দরজার পিছনে থাকা সম্পদের পরিমাণের থেকেও অনেকটা বেশি। বলা হয়, এই দরজাকে নাকি প্রাচীন কোন মন্ত্র দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছে।
তবে এই দুই মন্দির নয়। বিশ্বের ধনীতম মন্দিরের তালিকায় রয়েছে, তিরুপতির মন্দির। যা অন্ধ্রপ্রদেশের চিত্তুর জেলায় অবস্থিত। মনে করা হয়, এই মন্দিরের ট্রাস্টের অধীনে রয়েছে ৯ হাজার কেজি সোনা। এর মধ্যে ৭ হাজার কেজির কিছু বেশি সোনা রাখা রয়েছে দুটি ব্যাঙ্কে। আর বাকি সোনা রয়েছে এই মন্দিরেই। এই মন্দিরে প্রতি বছর শুধু দান আসে ১ হাজার থেকে ১২০০ কোটি টাকা মতন।
এছাড়াও রয়েছে শিরডির সাইবাবা মন্দির। এখানে রয়েছে ৩২ কোটি টাকার সোনা, প্রায় সাড়ে চার হাজার কেজি রুপো, এবং ১৮০০ কোটি টাকা। এই মন্দিরেও প্রতি বছর দান পড়ে ৩৫০ কোটি টাকা মতন। এদিক থেকে পিছিয়ে নেই জম্মুর বৈষ্ণো দেবীর মন্দির। একটি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে, এই মন্দিরেও প্রতি বছর দানের অঙ্ক পৌঁছে যায় ৫০০ কোটির বেশি।
তবে শুধু অর্থ এবং সম্পদের বিচারে একটি মন্দির কতটা ধনী তার পরিমাপ করা ঠিক নয়। কারণ সম্পদ যা শুধু অর্থের মাপে বিচার করা হয়, তেমন কিন্তু নয়। ভারতের যে সকল প্রাচীন স্থাপত্য রয়েছে সেগুলো ভারতের সম্পদ। হাজার বছরের ইতিহাসে যার গায়ে একটুও আঁচ লাগতে পারেনি। যেমন ইলোরার কৈলাস মন্দির। সাধারণত, একটা বিল্ডিং তৈরি করা হয় কিভাবে? ইটের ওপর ইট সাজিয়ে, নিচ থেকে। কিন্তু কৈলাস মন্দির পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মন্দির যা তৈরি করা হয়েছে সিঙ্গেল একটি মাউন্টেন রক থেকে। যেমন নিখুঁত সেই শিল্পকলা, তেমনি নিখুঁত এই মন্দির তৈরির পিছনে পড়ে থাকা পরিশ্রম। ১২০০ বছর আগের একটা শিল্পকলা তৈরি হয়েছে ছেনি, হাতুড়ি দিয়ে…হাউ অ্যামেজিং ইজ দ্যাট! প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন, এই ধরণের স্থাপত্য তৈরি করতে গেলে ১০০ বছর সময় লাগা উচিৎ। কিন্তু বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, এই মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছিল মাত্র ১৮ বছরে। এই মন্দির নির্মাণের পিছনেই শুধু পরিশ্রম যায়নি, মন্দির ভাঙার পেছনেও অক্লান্ত পরিশ্রম চালানো হয়েছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যপার, সেই পরিশ্রমের নিট ফলাফল থেকে গিয়েছে জিরো। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব এক হাজার সৈন্য পাঠিয়ে এই মন্দির তিন বছরের মধ্যে পুরোপুরি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু একটি পাথরও সেই মন্দিরের দেয়াল থেকে ভাঙতে পারেনি মুঘল সম্রাটের সৈনিকরা। ঐ যে বললাম, সম্পদ শুধু অর্থের বিচারে হয় না। আমাদের হাজার বছরের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য- সেটাও এই ভারতেরই সম্পদ। এই নিয়ে বলব আরেকদিন।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ