Tourism
ছোটদের পড়াশুনোর চাপ হোক বা বড়দের কাজের চাপ। মাঝে যদি সামান্য ফুরসৎ মেলে, তখনই এদিকে ওদিকে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। আর ভারতের মত নিজের দেশ থাকতে, কেন বিদেশ ভ্রমণ করা? উঁচু উঁচু পাহাড়-পর্বত, গভীর সমুদ্র, বিস্তীর্ণ নদী, সীমান্তে মিশে যাওয়া মরুভূমি, ঘন অরণ্য আরও কত কী। সুতরাং অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষ হোক বা আয়েশে ছুটির কটা দিন কাটিয়ে দেওয়ার মত মানসিকতা হোক। প্রত্যেকেই সুযোগ পেলে একটু ঘুরে আসেন। আর শুধু আমাদের দেশের মানুষই নন। বিদেশ থেকেও প্রতি বছর ভারতে আসেন বহু পর্যটক। ছড়িয়ে পড়েন তাঁরা ভারতের বিভিন্ন কোণে। আজ আমরা ভারতের মোস্ট টুরিস্ট প্লেসগুলোর কথা যদি ভাবি, তাহলে আগ্রার তাজমহল, উত্তর-পূর্ব ভারত, বা রাজস্থানের ছবিটাই হয়ত সবথেকে বেশি চোখের সামনে ঘুরবে অথবা কাশ্মীর, লাদাখের ছবিটা। কিন্তু আপনাদের বলছি, ভারতের যে রাজ্যে সবচেয়ে বেশি ট্যুরিস্টদের পা পড়ে, তার নাম এই লিস্টে নেই। অন্তত মিনিস্ট্রি অফ ট্যুরিজম সেই তথ্যই দিচ্ছে। ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম স্ট্যাটিস্টিক্স ২০২১-এর রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি পর্যটকদের পা পড়েছিল আগ্রা, আসাম, মেঘালয়, রাজস্থান কোথাও নয়। বরং তামিলনাড়ুতে। একইভাবে ইন্ডিয়ান ট্যুরিজম স্ট্যাটিস্টিক্স ২০২২-এর রিপোর্ট বলছে, মহারাষ্ট্রের পর তামিলনাড়ুতেই সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটকদের পা পড়েছিল। সংখ্যাটা ১২ লক্ষের বেশি। কিন্তু এতো রাজ্য থাকতে কেন তামিলনাড়ু? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে বলা যাক, কিভাবে পর্যটনের ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে দেশের সকল রাজ্যকে পিছনে ফেলে দিচ্ছে তামিলনাড়ু।
আমরা সকলেই জানি তামিলনাড়ুর কালচারাল হিস্ট্রি ৪ হাজার বছরের পুরোনো। এই রাজ্যের ভাষাও অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটাই পুরোনো। সুপ্রাচীন কাল থেকেই তামিলনাড়ু চোল, পান্ডব এবং পল্লব রাজাদের কীর্তি নিয়ে সগৌরবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই রাজ্যের সঙ্গীত, নৃত্য, ফোক আর্ট, ফাইন আর্ট- সব ক্ষেত্রেই নিজের মৌলিকত্ব এখনো ধরে রাখতে পেরেছে। তামিলনাড়ুতে রয়েছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট, রয়েছে হিল স্টেশন, ওয়াটার ফলস, ন্যাশনাল পার্কস, এখানকার আঞ্চলিক খাওয়া দাওয়া, আর ওয়াইল্ড লাইফের জন্য তামিলনাড়ুর বৈচিত্র্য টেক্কা দিয়েছে অন্যান্য রাজ্যকে। প্রথমেই আসা যাক ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের কথায়। তার মধ্যে যেমন রয়েছে চোল টেম্পল- যা তৈরি করেছিলেন রাজা রাজা চোল, এবং তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোল। এটি তৈরি করা হয় ১১-১২ শতকে। এছাড়া রয়েছে থাঞ্জাভুরে বৃহদীশ্বর মন্দির, চোলাপুরমের গঙ্গাইকোনডা মন্দির, দারাসুরমের ঐরাবতেশ্বর মন্দিরের নাম করাই যায়। এই সকল মন্দিরগুলি দ্রাবিড় আর্কিটেকচারের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া মহাবলিপুরমের মন্দির। পর্যটকদের পা এখানে পড়েছে তাজমহলের থেকেও বেশি। এছাড়া বিখ্যাত মহাবলিপুরমের শোর মন্দির, সেভেন প্যাগোডা, রক রিলিফস, রথ টেম্পল এবং কেভ স্যানচুয়ারিজ বিখ্যাত। তবে এগুলো ছাড়াও তামিলনাড়ুর পর্যটক টানার অন্যতম কারণ এখানকার সিনিক বিউটি। আর যে কারণে নীলগিরি পর্বতের রেলপথ আজ ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের মধ্যে পড়ে। গুজরাত থেকে তামিলনাড়ু পর্যন্ত বিস্তৃত পশ্চিমঘাট পর্বতমালা আজ জীব বৈচিত্র্যের কারণে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত।
তামিলনাড়ু হচ্ছে পশ্চিমঘাট এবং পূর্বঘাটের মিলিত পয়েন্ট। পঞ্চাশের বেশি হিল স্টেশন রয়েছে এই রাজ্যে। তার মধ্যে বিখ্যাত উটি, কোদাইকানাল, কুন্নুর, ইয়েলাগিরি, ভালপারাই, জাভারি হিলস, পাচাইমালাই হিলসের মত এমন পাহাড়, জঙ্গলে ঘেরা জায়গাগুলো পর্যটকদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া নীলগিরি হিলস, পানালি হিলস, শিবারয় হিলস, কারডামম হিলস গভীর জঙ্গল এবং জীব বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও রয়েছে দেশের প্রথম সারির বেশ কিছু সুন্দর জলপ্রপাত। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কুরতাল্লাম ওয়াটার ফলস, হোগেনাক্কাল ফলস ইকো-ট্যুরিজমের জন্য আজ সকলের পরিচিত। এছাড়াও আরও বেশ কিছু জলপ্রপাতের দেখা মেলে এই পূর্বঘাট এবং পশ্চিমঘাট পর্বতে। এই রাজ্যের জীব বৈচিত্র্য কম নয়। পিচাভরম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এখানে ২০০-র বেশি প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এছাড়া নীলগিরি পাহাড়ের জঙ্গলে পাওয়া যাবে বহু বন্যপ্রাণী। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্ডিয়ান এলিফ্যান্ট, নীলগিরি তাহার, বাঘ, গৌর, ফ্লায়িং স্কুইরেল, সম্বর, নীলগিরি লেঙ্গুর এবং ইন্ডিয়ান লেপার্ড। এখানে রয়েছে বেশ কিছু অভয়ারণ্য, পাখিরালয়। অতএব অরণ্যপ্রিয় মানুষের জন্য তামিলনাড়ুর বিকল্প পাওয়াটা বেশ কঠিন।
তামিলনাড়ুতে ৩৪ হাজারের বেশি হিন্দু মন্দির রয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশ মন্দিরের ইতিহাস বহু প্রাচীন। আর যে কারণে তামিলনাড়ুকে টেম্পল টাউনও বলা হয়ে থাকে। দ্রাবিড়িয়ান শিল্পকলার সঙ্গে পরিচয় করতে হলে তাই কৈলাসনাথর মন্দির, কামাক্ষী আম্মান মন্দির, ত্রিলোক্যনাথ মন্দির, একমবারেশ্বরার মন্দির গুরুত্বপূর্ণ। তবে এসবের মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য মন্দির হল রামেশ্বরম মন্দির যা প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো। এছাড়া শ্রীরঙ্গনাথস্বামী মন্দির এখনো নিজের ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে। যদিও শুধু হিন্দু মন্দির নয়। এখানে মুসলিম, খ্রিস্টান এবং জৈন মন্দিরগুলো ট্যুরিস্টদের জন্য খুব বিখ্যাত। আর রয়েছে বিখ্যাত কিছু সমুদ্র সৈকত। যা গোটা রাজ্যের ট্যুরিজম সেক্টরকে বুস্ট আপ করছে। আর সব শেষে মেডিক্যাল ট্যুরিজম হাব। তামিলনাড়ু এমনই একটি জায়গা যেখানে সিদ্ধা, আয়ুর্বেদ, হোমিওপ্যাথি এবং ইউনানি চিকিৎসা করা হয়। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা এই মেডিক্যাল ট্যুরিজমে উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছে। জানা গিয়েছে, তামিলনাড়ুর চেন্নাই এখন এশিয়ার অন্যতম বড় মেডিক্যাল ট্যুরিজম হাব হিসেবে উঠে আসছে।
ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলোর মধ্যে তামিলনাড়ুর মত এমন সার্বিক বৈচিত্র্যপূর্ণ রাজ্য মনে হয় আর একটিও নেই। মিনিস্ট্রি অফ ট্যুরিজমের তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, তামিলনাড়ু আজ ভারতের সবথেকে বড় ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশন হিসেবে উঠে এসেছে সবার আগে। ডোমেস্টিক ট্যুরিস্টদের ২১.৩১% এবং বিদেশি ট্যুরিস্টদের ২১.৮৬% শুধু তামিলনাড়ুই ঘুরতে আসেন। বছরভর পর্যটকদের পা পড়ে এখানে। বর্তমানে তামিলনাড়ুর জিডিপি ২৬০ বিলিয়ন ডলার। মহারাষ্ট্রের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক জিডিপির এই রাজ্যের আয়ের একটা বড় অংশ আসে এই পর্যটন খাত থেকেই। তামিলনাড়ুর পর্যটন শিল্প এতো ছোট নয়। একবার ঘুরেই যেখানে পুরো দেখা সম্ভব নয়, সেখানে ছোট একটা প্রতিবেদনে কতটুকুই বা বলা সম্ভব? তাই আর দেরি না-করে ভারতীয় সংস্কৃতির শিকড় যদি খুঁজতে হয়, তাহলে বিদেশ ভ্রমণ ক্যান্সেল করে ঘুরে আসুন তামিলনাড়ু।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ