Tourism
সাহিত্যের পাতায় উঁকিঝুঁকি মারা যাদের অভ্যাস, তাঁদের কাছে হাওয়া বদল শব্দটা খুব পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ বিভূতিভূষণের বহু লেখায় এই হাওয়া বদলের উল্লেখ রয়েছে। তিনি নিজেও যে সময়সুযোগ পেলে, হাওয়া বদলের জন্য বেরিয়ে পড়তেন। তবে যেখানে-সেখানে নয়। কারণ বিভূতিভূষণের এই হাওয়া বদলের অন্যতম প্রিয় জায়গা ছিল গালুডি-ঘাটশিলা। ছোট ছোট পাহাড়, অরণ্য এবং সুবর্ণরেখার হাওয়া ছড়িয়ে ঘাটশিলা বাঙালিদের বহু আগেই আপন করে নিয়েছে। তাই ভ্রমণপ্রিয় বাঙালি তাকে উপেক্ষা করবে, তা কী করে হয়? আজ বাঙালিদের চটজলদি ঘুরে বেরানোর জায়গা বলতে শুধু দিঘা, পুরী, দার্জিলিং। সেই লিস্টে ঘাটশিলা, গালুডি তেমন একটা ঠাঁই পায় না। কিন্তু এখানে প্রকৃতি যেন নিজেকে সবদিক থেকে ছড়িয়ে দিয়েছে। তার সঙ্গে মিশে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা। আর প্রকৃতি এবং আধ্যাত্মিকতা যেখানে মিশে যায়, সেই জায়গা পর্যটকদের কাছে অন্য মাত্রায় পৌঁছে যায়। তাই আজ বিজনেস প্রাইম নিউজের পক্ষ থেকে ঘুরে বেরাতে ভালোবাসে বাঙালিদের ছোট্ট একটা সফর করিয়ে আনা যাক ঘাটশিলা থেকেই। সঙ্গে ঘাটশিলার মিনি দার্জিলিং-টাও একবার দেখে নেওয়া যাক নাকি?
ঝাড়গ্রামের জঙ্গল, পাহাড়ে ঘেরা লাল মাটির দেশ ঘাটশিলা। বাঙালির পায়ের তলায় সর্ষে রয়েছে, এই প্রবাদটা ঘাটশিলার জন্য যথার্থ। কারণ, ঘাটশিলায় এসে আপনি শুধু বসে থাকবেন- এই যদি মনে করে থাকেন, তাহলে বলব, আপনি কিন্তু বড় মিস করবেন। কারণ ঘাটশিলায় প্রায় ১৪-টি জায়গা রয়েছে, পর্যটকদের জন্য। যেখানে ঘুরে আসাটা মাস্ট। তার জন্য চিন্তার তো কিছু নেই। কারণ অটো ভাড়া করে, গাইড নিয়ে আপনি প্রত্যেকটা জায়গা ঘুরে আসতে পারেন নিজের মতন করে। যেহেতু এই জায়গাটা পর্যটনের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, তাই এখানকার মানুষগুলো পর্যটকদের ঘুরিয়ে আনার জন্য কোনরকম কার্পণ্য করেন না। বরং ঘাটশিলার স্মৃতি যেন সারাজীবন সঙ্গে থাকে, সেটাই এঁরা লক্ষ্য রাখেন ভালোরকম। এবার বলি, ঘাটশিলায় কোন কোন জায়গায় ঘুরবেন? রয়েছে বেশ কিছু জায়গা। তবে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চিত্রকূট পাহাড়, সিদ্ধেশ্বরী শিব মন্দির, সুবর্ণরেখার পাড়, রঙ্কিণী দেবীর মন্দির, গালুডি ব্যারেজ, বুরুডি ড্যাম এবং অবশ্যই বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরিকুঞ্জ।
যদি ঘাটশিলা ট্যুরকে আপনি কোথায় যাবেন, কিভাবে দেখবেন- সেভাবে প্ল্যান করে নিতে পারেন তাহলে কিন্তু অসুবিধা হবার কথা নয়। যেমন প্রথম দিন আপনার বুকিং করা লজ থেকে একটা অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমেই চলে আসুন চিত্রকূট পাহাড়ে। খেয়াল রাখবেন, এই পাহাড়ে উঠতে গেলে কিন্তু উঁচু-নিচু শিলাবৃত পথ ধরেই যেতে হবে। পাহাড়চূড়ায় রয়েছে মন্দির। আর যত পাহাড়ের ওপরে উঠবেন, ততই অবাক হয়ে যাবেন আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে। পাহাড় চূড়ার মন্দিরের সকাল বেলার দৃশ্য একরকম। আর সন্ধ্যে নামলেই প্রকৃতির নৈঃশব্দ চিড়ে বেজে ওঠা মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি আপনাকে মোহিত করে দেবেই।
চিত্রকূট পাহার ছুঁয়ে এবার চলে আসা যাক সুবর্ণরেখার ধারে। আপাত মৃতপ্রায় মনে হলেও, সুবর্ণরেখা যে সুবর্ণরেখাই। বড় বড় প্রাকৃতিক বোল্ডারের উপরে হামাগুড়ি দিয়ে বয়ে চলেছে এই নদী। তবে ভরা গরমে জলস্তর কম মনে হলেও, বর্ষায় সুবর্ণরেখা বড় ছটফটে হয়ে ওঠে। তখন কিন্তু সুবর্ণরেখাকে এখনকার মত শান্ত মনেই হবে না। সে এক অন্য রূপের সাক্ষী থাকবেন আপনারা।
সুবর্ণরেখার হাওয়া গায়ে মেখে এবার বরং চলে আসুন আরেকটি মন্দিরে। রঙ্কিণী মায়ের মন্দির। এই মন্দিরটি ১৯৬৪ সালে এখানে তৈরি করা হয়। তারপর থেকেই মন্দিরটি ঘাটশিলায় খুব জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে নিয়েছে। দু’পাশে গাছের ঘন জঙ্গল। লাল মাটির পথ কামড়ে শাল মহুয়া গাছের ছায়া ধরে পৌঁছে যেতে পারেন জাদুগড়া রঙ্কিণী মন্দিরে। পাহাড় কেটে এই মন্দিরটি করা হয়েছে। কথিত আছে দেবী নিজেই প্রকাশিত হয়েছেন। সেই মন্দিরে পুজো দেওয়ার লাইন পড়েছে। যেখানে শুধু স্থানীয়রাই নন, এখানে পর্যটকদের পা পড়ে এখানে ভালোরকম। তাই ঘাটশিলায় ঘুরতে এসে রঙ্কিণী দেবীর মন্দিরে যাবেন না, সেটা কী করে হয়? রঙ্কিণী দেবীর মন্দির দর্শন হয়ে গেলে, তারপর আর কী? সটান চলে আসতে পারেন বিভূতিভূষণের বাড়ি গৌরিকুঞ্জে। ঘাটশিলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান এটি। তারপর অবশ্যই রামকৃষ্ণ মিশনে একবার ঢুঁ মেরে যাবেন। এখানে সন্ধ্যারতি আপনাকে মনোমুগ্ধ করে দেবে নিশ্চিত। প্রথম দিনের জন্য এইটুকুই যথেষ্ট। ফিরে আসুন নিজের লজে। তারপর সেদিনের মত বিশ্রাম।
দ্বিতীয়দিন ঘাটশিলার বাকি জায়গাগুলো ঘুরে ফেলুন অটো ভাড়া করে। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে বাদবাকি জায়গাগুলো খানিকটা সময় নিয়ে দেখতে পারবেন। চলে আসুন পাহাড়ে ঘেরা সিদ্ধেশ্বরী শিব মন্দিরে। প্রায় ১৯০০ ফুট উঁচুতে আঁকাবাঁকা খাড়া রাস্তা ধরে একটু হাঁটা আর একটু বিশ্রাম করতে করতে পৌঁছে যান একেবারে পাহাড়ের শীর্ষে। শিব মন্দির, শিবলিঙ্গ, একই সঙ্গে দেখে ফেলতে পারবেন। চারিপাশে সারিবদ্ধ পাহাড়। তার যেন আদি নেই অন্ত নেই। বেড়াতে আসার সার্থকতা খুঁজে পাবেন সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে আসতে পারলে। সিদ্ধেশ্বরী মন্দির দর্শন হয়ে গেলে তারপর চলে আসুন রাতমোহনা ফলস। কোথা থেকে এই বারি ধারা অবিরাম বয়ে চলেছে তা প্রকৃতিই জানে। এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে বাকরুদ্ধ করে দেবেই। এর অনতিদুর বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা। এখানে অবশ্য সুবর্ণরেখা খরস্রোতা। অফ সিজনেও তার ভয়ঙ্করতার প্রমাণ মিলল। তারপর ছুটে চলা গালুডি ব্যারেজের উদ্দ্যেশ্যে। আপাতত অফ সিজন থাকায় প্রত্যেকটি গেটেই তোলা। একটি, দুটি গেট দিয়ে জল সামান্য বয়ে চলেছে। বর্ষাকালে এই ব্যারেজটি ভয়ঙ্কর হয়। ঘাটশিলায় যে সামান্য পরিমাণ চাষবাস হয় তার উৎস গালুডি ব্যারেজ। এই ব্যারেজ মনে করিয়ে দেয় দুর্গাপুরের ডিভিসি ব্যারেজকে। দুটির মধ্যে পার্থক্য হল গালুডি বোল্ডার দিয়ে গাঁথা, আর দুর্গাপুর ব্যারেজে আছে রাশি রাশি বালি। এরপর এখান থেকে চলে যেতে পারেন ফুল ডুংরী হিল। সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের মত এই জায়গাটা তেমন ফেমাস না-হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ফুল ডুংরী হিল কোন অংশে কম নয়।
তারপর চলে আসুন ঘাটশিলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় জায়গা বুরুডি লেকে। চতুর্দিকে বড় বড় পাহাড় তার মাঝখানে অপূর্ব এক লেক। চোখ জুড়িয়ে যাবে। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলুন। দেশি মুরগির ঝোল ১৫০ টাকা প্লেট, নিরামিষ ৫০ টাকা, মাছ নিলে ৬৫। ওমলেট ১৫ টাকা। তারপর ছুট লাগান গিরি ফলসে। ওখানকার ব্যবস্থা অনুযায়ী সঙ্গে গাইড নিয়ে নেবেন। গাইডের দক্ষিণা ৫০ টাকা। কচিকাঁচা আদিবাসী যাদের একটা বড় অংশ শবর, শিশুরা সেখানে ভিড় জমিয়ে থাকে কিছু খাবারের আশায়। এই গরীব মানুষগুলোই এখানে গাইডের কাজ করে। তাছাড়া মাঝেমধ্যেই হাতির দল নাকি চলে আসে এখানে। তাই গাইড নিয়ে যাওয়াটাই সবথেকে সেফ। কিন্তু ঘাটশিলায় মিনি দার্জিলিং কোনটা, সেটা তো বলা হল না। আর বলব না। এবার নিজের মুখেই শুনে নিন।
দু’দিনের জন্য অটো ভাড়া করলে ২ হাজার টাকায় আপনি ঘাটশিলার সব জায়গাগুলো আরাম করে ঘুরে আসতে পারবেন। নিত্যদিনের কাজের চাপ, অফিসের ব্যস্ততা, ধুলো-ধোঁয়ার শহরে দিনযাপন করতে করতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়বেন, তখন ফুরসৎ পাবার জন্য ঘাটশিলা দু’দিনের মোক্ষম দাওয়াই হতে পারে। সব ক্লান্তি ভুলে যাবেন। সব দুর্ভাবনা মিটে যাবে। ঘাটশিলার নৈসর্গিক দৃশ্য আপনাকে নতুন করে জীবন যুদ্ধে নেমে পড়ার জন্য অক্সিজেন দেবে। তারপর আর কী- আবার পুরো উদ্যমে শুরু করবেন নতুন করে দিনলিপি লেখা।
সুব্রত সরকার
ঘাটশিলা