Tourism
চিন- যাকে বলা হয়ে থাকে ওয়ার্ল্ড ম্যানুফ্যাকচারিং হাব। এমন কোন পণ্য নেই যা চিনে ম্যানুফ্যাকচার করা হয় না। ন্যূনতম পারিশ্রমিকের বিনিময়ে এখানে লক্ষ লক্ষ কর্মচারী বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরেই চিনে একের পর এক কোম্পানি নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটকে নিয়ে চলে এসেছে লাল ফৌজের দেশে। অ্যাপল হোক বা নাইকি- একের পর এক বিদেশি প্রথম সারির সংস্থা কম খরচে ম্যানুফ্যাকচারিং-এর জন্য চিনের ওপরেই ভরসা রাখে। তার অন্যতম কারণ- চিনের লেবার কস্ট। কিন্তু আজ চিনের লেবার কস্ট দিন দিন বাড়ছে। যে কারণে প্রোডাক্টের দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেটা বিদেশি কোম্পানিগুলোর জন্য প্রফিট মার্জিন একটু কমিয়ে আনছে। আর সেই কারণেই কি আজ চিন ছাড়া হচ্ছে অ্যাপল বা নাইকির মতন বিদেশি কোম্পানিগুলো? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা করব সেটা নিয়েই।
প্রিয় দর্শক, ২০০৭ সালে যখন স্টিভ জবস প্রথম আইফোন লঞ্চ করেছিলেন, সেই সময় চিনে লেবার কস্ট ছিল দিনে মাত্র ১ ডলার। লেবার কস্টের এই অঙ্কটা কিন্তু সেই সময় থাইল্যান্ড বা ফিলিপিন্সের থেকেও অনেকটাই কম ছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ধীরে ধীরে সেই লেবার কস্ট বাড়তে বাড়তে আজ পৌঁছে গিয়েছে দিন প্রতি ৮ ডলারে। আর সেটা অন্য দেশের থেকে অনেকটাই বেশি। খেয়াল রাখবেন, দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র চিলিতেই লেবার কস্ট চিনের বর্তমান লেবার কস্টের থেকে অনেকটা বেশি। তবে আফ্রিকাতে লেবার কস্ট অনেকটাই কম। এছাড়া সাউথ ইস্ট এশিয়ার কথা যদি বলি, তাহলে দেখব, ভারত-থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে লেবার কস্ট চিনের থেকে অনেকটাই কম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও নিচে। আর যে কারণে চিনে ম্যানুফ্যাকচারিং করাটা বিদেশি সংস্থার জন্য বেশ খরচসাপেক্ষ হয়ে উঠছে। কিন্তু চিনে এই লেবার কস্ট বৃদ্ধি পাবার অন্যতম কারণ এই দেশের পপুলেশন।
চিনের ইতিহাসের দিকে একটু খেয়াল রাখি, তাহলেই বিষয়টা স্পষ্ট হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর চিনের ইকোনমির অধিকাংশটাই নির্ভরশীল ছিল এগিকালচারাল সেক্টরের উপর। সেই সময় পপুলেশন তেমন একটা ছিল না। আর যে কারণে কৃষিক্ষেত্রে চিন যাতে আরও বেশি স্বাবলম্বী হতে পারে, তার জন্য চিন সরকার পপুলেশন বৃদ্ধির দিকে মনযোগী হয়। সত্যি বলতে কি, মাও-জে-দং মনে করতেন, চিনের পপুলেশন বৃদ্ধিটা চিনের অর্থনীতির জন্য সুখসমৃদ্ধি নিয়ে আসতে পারে। আর পপুলেশন বৃদ্ধি মানেই এসে যায় আরবানাইজেশনের বিষয়। আরবানাইজেশন মানেই গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে বেশি করে মানুষ থাকতে শুরু করল। সেখানে উচ্চ শিক্ষা, প্রযুক্তিবিদ্যা ইত্যাদি বিষয়ে আরও বেশি করে পড়াশোনা করতে শুরু করল চিনের ছাত্রছাত্রীরা। এটাই আগামীতে হাই স্কিলড এমপ্লয়ি তৈরি করতে বিশেষ সুবিধে করে দিয়েছিল।
জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, এদিকে সেই মতন কাজের সুযোগ নেই। আর এটাই বিদেশি সংস্থাগুলোর কাছে তুরুপের তাস হয়ে উঠল। তারা ঠিক করল, তাদের নিজস্ব ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটকে নিয়ে আসবে চিনে। কারণ, কম পারিশ্রমিকের পরিবর্তে পাওয়া যাবে উন্নত মানের পণ্য। চিনের সাধারণ মানুষের হাতে কাজ না-থাকায় তারাও নামমাত্র ডেলি ওয়েজেস নিয়ে নিজেদের কাজে লেগে পড়ল। এভাবেই চিন হয়ে উঠতে থাকে ম্যানুফ্যাকচারিং হাব। ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। ১৯৮০ সালের কথা। চিন সরকার দেখল, তাদের পপুলেশন এমন বেনজির বৃদ্ধি পাচ্ছে যে দিনের শেষে হয়ত সেটা সরকারের ক্ষমতার মধ্যে নাও থাকতে পারে। আর যে কারণে চিন সরকার ঐ বছর নিয়ে এলো ওয়ান চাইল্ড পলিসি। কিন্তু সেটা যে দিনে দিনে উল্টো চাপ তৈরি করবে, কেউ ভেবেছিল? মুশকিল হচ্ছে, সেই সময় যারা ইয়ং ওয়ার্কারস ছিল, আজ তারা রিটায়ারমেন্টের দোরগোরায়। এদিকে আগের মত সেই ওয়ার্ক ফোর্স নেই। ভালোরকম ঘাটতি দেখা যেতে শুরু করায় চিনে নিত্যদিন লেবার কস্ট বাড়তে শুরু করে। আর এখন যা অবস্থা, এই পারিশ্রমিকের থেকে কম পারিশ্রমিকে কেউ কাজ করতেও চাইবে না। এমনিতেই চিনে যখন লকডাউন চলছিল, তখনই বহু সংস্থা চিনের ওপর থেকে নিজেদের ভরসা হারাতে শুরু করে। একইসঙ্গে অন্য দেশে নিজেদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট তৈরি করার কথা ভাবে। এখন পুরো পৃথিবীর মার্কেট একেবারে পাল্টে যাচ্ছে। চিরাচরিত ধারা থেকে বেরিয়ে গিয়ে ওয়ার্ক কালচার একেবারে পাল্টে যাচ্ছে অন্যরকম। তার জন্য চিন সরকারকে সরাসরিভাবে প্রপার এডুকেশন দিতে হবে। এখন বিষয়টা হল, চিনে এডুকেশন সিস্টেম যথেষ্ট ভালো। পড়াশোনা করে যারা ডিগ্রি নিচ্ছেন, তারা যে হাই স্কিলড কর্মচারী হবে সেই বিষয়ে কোনরকম অসুবিধা থাকার কথাই নয়। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে যে, চিনে এই এডুকেশন পলিসি কিন্তু শহরের এলিট ক্লাস বা মধ্যবিত্তরাই পেয়ে থাকেন। এই দেশে এমন বহু মানুষ রয়েছে যাদের কোন ডিগ্রি নেই, টেকনিক্যাল নলেজ নেই। ফলে গ্লোবাল মার্কেটে চিনের একাধিপত্য জারি থাকাটা একটু সমস্যার হতে পারে।
তাহলে কি চিনের ইকোনমিক্স কোলাপস করতে পারে? আপাতত সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তার কারণ হল, কোন দেশে বিজনেস সেট-আপ করতে গেলে, সবার আগে প্রয়োজন বিদ্যুৎ, জল এবং ভালো রাস্তা। চিন সরকার বিদ্যুতের খরচ কমিয়ে দিয়েছে। একইসঙ্গে ট্যাক্সেও যথেষ্ট কাটছাঁট করছে চিন। তাছাড়া চিন দেশটা অনেক বড়। সেটাও চিনের অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট ভালো। যেমন আইফোন সিটি। অথবা এমন শহরও রয়েছে যেখানে ক্রিসমাসের জন্য বিভিন্ন পণ্যই শুধু ম্যানুফ্যাকচার করা হয়। তাই চিনে ইয়ং পপুলেশন একেবারে কমে যাচ্ছে, সেটা বলাও কিন্তু ঠিক নয়। এই দেশের ইয়ং পপুলেশন এখনো থাইল্যান্ড বা ভিয়েতনামের থেকে বেশি। তবে চিন এখন অন্য সলিউশনের কথাও ভাবছে। যেটা তার জন্য পার্মানেন্ট হতে পারে। আর সেটা হল কনজাম্পশন বেসড ইকোনমি। চিনের সাধারণ মানুষের হাতে এখন দামি দামি ব্র্যান্ডের পণ্য হাতে উঠছে। এর মাধ্যমে চিন বিদেশি কোম্পানিদের জন্য দুর্দান্ত একটা মার্কেট তৈরির জায়গাটাও করে রাখছে। আজ চিনে যেহেতু কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমছে, সেই জন্য চিন নিজেও অন্য একটা পলিসি নিয়েছে যেমন ডেট ট্র্যাপ। চিন বিভিন্ন দেশে ডেট ট্র্যাপ ছড়িয়ে রাখছে। সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ হতে পারে পাকিস্তান। চিন এমন সব দেশে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের কাজ করে যেদেশগুলো ধার শোধ করতে পারে না। পাকিস্তানে চিন ইতিমধ্যেই ৩০ থেকে ৪০ বিলিয়ন ডলার লোন নিয়েছে। তার জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচারের কাজ করছে চিন সেখানে। এদিকে পাকিস্তানের অবস্থা আমরা সকলেই জানি। পাকিস্তান শোধ না-করতে পারার কারণেই চিন নিজের দেশের টাকাই এই নির্মাণের কাজে ব্যবহার করছে। তৈরিও করছে চিনের সংস্থা। নিজের টাকা নিজের ঘরেই থাকল, সঙ্গে চিন আবার শোধ করতে না-পারলে সেই জায়গাটা নিজেদের দখলে নিয়ে নেবে। আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় চিন নিজেও সেই কাজটা করে ফেলছে। আফ্রিকাতেও একটানা মাইনিং চালিয়ে যাচ্ছে চিন। ফলে চিনের দাদাগিরি আজ সর্বত্র। আর এটাও বিদেশি সংস্থার জন্য বেশ আশঙ্কার হতে পারে। তাহলে এখন কী করা উচিৎ? ম্যানুফ্যাকচারিং হাব থেকে ধীরে ধীরে চিনকে বিভিন্ন অ্যাডভান্সড সেক্টরে নিজেদের মনযোগী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ