pujo scope 2022
কলকাতা। এই কলকাতা যতটা রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ বা অমর্ত্য সেনের, ঠিক ততটাই আমার, আপনার, সবার। শিল্প, সংস্কৃতির এক দুর্দান্ত মিলমিশের শহর আমাদের কলকাতা- কালচারাল ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। কলকাতা মানেই আবেগ, কলকাতা মানেই ভালোবাসা আর কলকাতা মানেই অফ কোর্স খাওয়া-দাওয়া। কিন্তু এই সবকিছুকে ছাপিয়েই কলকাতার আরেকটা আইডেন্টিটি হল দুর্গা পুজো। কলকাতার বুকে এক চলমান ইতিহাস। যার ঐতিহ্য ফ্যাকাশে হবার নয়। ৩০০ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী বহন করা কলকাতা শহরের কোনকিছুই যে হারিয়ে যাওয়ার নয়। ধর্ম থেকে সংস্কৃতি, রাজনীতি থেকে রীতিনীতি- সবকিছুই কলকাতাকে দিয়েছে এক অনন্য আইডেন্টিটি।
ধর্ম যার যার উৎসব সবার। সত্যিই তো উৎসব সবারই। কলকাতা নিজেই তার সবথেকে বড় প্রমাণ। ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন মানসিকতার সহাবস্থান যা কার্যত এক ছাতার তলায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে নগরবাসীকে। আর বারবার চোখে আঙুল দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে, কলকাতা মানেই নানা রঙ, নানা রূপের এক বৈচিত্র্যের শহর। এই তো কয়েকদিন আগেই ‘ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অফ হিউম্যানিটি’র স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার দুর্গা পুজো। স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনেস্কো। কিন্তু এই স্বীকৃতি কি কলকাতার দুর্গা পুজোকে আলাদা কোন বাড়তি জৌলুশ দিল? হয়ত হ্যাঁ, হয়ত না। কারণ, বাঙালির দুর্গা পুজো নিয়ে যে উন্মাদনা- সেটা বহু আগে থেকেই কলকাতাকে বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা একটা জায়গা করে দিয়েছে, অনেকটা স্পেনের লা টোমাটিনা ফেস্টিভ্যালের মতনই যা গোটা বিশ্বের কাছ থেকে পেয়েছে বেনজির স্বীকৃতি।
শরতের গন্ধ যখন নাগরিক ব্যস্ততার সঙ্গে মিলেমিশে যায়, ঠিক তখন থেকেই বড় অন্যরকম মনে হয় কলকাতাকে। বিক্রিবাটা, ট্র্যাফিকের ব্যস্ততা, মানুষের জটলা- ঠিক পুজো আসার আগে-আগে কলকাতা নিজেই হয়ে ওঠে এক দুর্দান্ত ক্যালাইডোস্কোপ। তখন কলকাতার বুক থেকে মিটিং-মিছিলের গন্ধটা যেন একেবারে উধাও হয়ে যায়। পুজোর রঙে, পুজোর গন্ধে ভেসে যায় কলকাতা। ব্যস্ততা বাড়ে কুমোরটুলির শিল্পীদের। ব্যস্ততা বাড়ে প্যান্ডেল তৈরির কারিগরদের। ব্যস্ততা বাড়ে ব্যবসায়ীদের। ভিড় বাড়ে সাধারণ মানুষের। গোটা শহর ছয়লাপ হয়ে যায় ব্র্যান্ড এবং স্পন্সরারদের বিজ্ঞাপনে। একইসঙ্গে শুরু হয় তীব্র প্রতিযোগিতা। থিমের পুজো নাকি সাবেকিয়ানা? কে থাকবে এগিয়ে? আর কেই বা পড়বে পিছিয়ে? আর কোন প্যান্ডেল জয় করে নেবে সবার মন? এই সবকিছুই কলকাতার রঙ যেন একধাক্কায় চড়িয়ে দেয় অনেকটাই।
আসলে দুর্গা পুজো শুধু আর পুজোর মধ্যেই আটকে নেই। শিল্পী থেকে ব্যবসায়ী সকলের কাছেই হয়ে উঠেছে এক মহোৎসব। এই পুজোর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষের রুজিরোজগার একধাক্কায় বেড়ে যায় অনেকটাই। যত ঘনিয়ে আসে দিন, ততই যেন ব্যস্ততার পারদ চড়তে থাকে। দোকানে-দোকানে পসরার ঢল, হরেক কিসিমের জিনিস। তার হরেক কিসিমের দরদাম। শপিং মল থেকে ফুটপাথ, অথবা অ্যামাজন থেকে ফ্লিপকার্ট। সর্বত্রই শুধু বিক্রির জোয়ার। খেটে খাওয়া শিল্পীদের পরিশ্রম, প্রান্তিক ব্যবসায়ীদের পরিশ্রম। চারিপাশে শুধু ব্র্যান্ডের ছয়লাপ। ব্যবসায় জোয়ার, শিল্পীদের মুখে হাসি। কারিগরদের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সর্বজনীন স্বীকৃতি। আর এই সব মিলিয়েই কলকাতার দুর্গা পুজো তৈরি করে এক অনন্য ছবি। তাই সবশেষে শুধু একটাই কথা- মায়ের আশীর্বাদ নিয়েই নিঃসন্দেহে পাকাপোক্ত হয় বাংলার অর্থনীতি, বাংলার ব্যবসা।