pujo scope 2022
কানে ব্লু-টুথ আর হাতে মোবাইল। বর্তমান প্রজন্মের এই অভ্যেস ধীরে ধীরে স্মৃতির অতলে ফেলে দিয়েছে গান শোনার সেই যন্ত্রকে। অথচ একটা সময় ছিল, যখন আশ্বিনের শারদ প্রাতে ঘরে ঘরে বেজে উঠত বীরেন ভদ্রের মহিষাসুরমর্দিনী। আধুনিকতার মোড়কে আজ হাতের নাগালে সব কিছু। কিন্তু কোথাও যেন বিষাদবার্তা থেকেই গেছে। কারণ আজ আর নেই কলের গান। ইংলিশে যার নাম গ্রামোফোন। কালো থালার মত রেকর্ড, আর সেখান থেকেই ভেসে আসে মায়ের আগমনী গান। শহরের বুক থেকে সেই ঐতিহ্য কিভাবে যেন দিনে দিনে মিশে গেল ভিড়ে। এখন গ্রামোফোনের ঠাঁই ঘরের ঐতিহ্য বৃদ্ধির জন্যই- দাঁড়িয়ে থাকে এককোণে, অচলমুদ্রার মতন।
১৮৮৭ সালে জার্মান সায়েন্টিস্ট এমিল বার্লিনারের হাত ধরেই বিশ্ব পরিচিতি পায় গ্রামোফোনের। মানুষের কানে পৌঁছতে সে খুব একটা সময় নেয় নি। ১৯০২ সালে ভারতে তৈরি হল এই গ্রামোফোনেই প্রথম রেকর্ড। ফ্রেডরিখ গেইসবারগ কলকাতা থেকে রেকর্ড করে নিয়ে যান বাঘা বাঘা শিল্পীদের গান- যার মধ্যে রয়েছেন গওহরজান, জানকীবাই এর মতন শিল্পীরা। ধীরে ধীরে হিন্দি শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের সঙ্গে শুরু হল বাংলা গানের রেকর্ডিং এই গ্রামোফোনে, যার একটা বাংলা নাম আমরা পেয়ে গেলাম- কলের গান। রামপ্রসাদী গান, নিধুবাবুর টপ্পা, কীর্তন, বাউল সঙ্গীত আরও কত কী! সেই গ্রামোফোনে প্রথম পুজোর গান রেকর্ড হয় ১৯১৪ সালে। ১৪-টি গান রেকর্ড করা হয়েছিল। নাম ছিল- শারদাবলী, দাম ছিল ৩ টাকা ১২ আনা। সেই সময় কিন্তু এই মূল্যটা নেহাত কম ছিল না। সরলাবাই, কে মল্লিক, মানদাসুন্দরী দাসীর মত শিল্পীর কণ্ঠ শুনতে পাওয়া গেছিল।
হিন্দুস্তান রেকর্ড, পায়োনিয়ার রেকর্ড দেখল অচিরেই যেন পুজোর গান দুর্দান্ত সাফল্য পেল। ব্যস, পরবর্তীকালে বের করতে শুরু করল তারাও, এই পুজোর সময়। এই পুজোর গান গ্রামোফোনের মাধ্যমে ঢেউ তুলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দাস। সাল ১৯৩১। তারপর তুমুল চর্চায় চলে এলো ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের আগমনী বা ভক্তিমূলক গীতি। এছাড়া ইন্দুবালা দেবী, পঙ্কজ মল্লিকের মত শিল্পীদের কণ্ঠ শোনা যেত এই কলের গান থেকেই। তবে দুর্গা পুজো এবং বাঙালির চিরন্তন আবেগ যেন এক রেকর্ডে গাঁথা হয়ে গেল যখন আকাশবাণী থেকে মহালয়ার দিন প্রভাতী অনুষ্ঠান মহিষাসুরমর্দিনী রিলিজ করল। এই অনুষ্ঠানের মূল পিলার ছিলেন তিন জন- বাণী কুমার, পঙ্কজ মল্লিক এবং অবশ্যই বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র। বাঙালির আবেগ বাঁধ ভাঙল। কলের গান এবং মহালয়ার পুণ্য প্রাত যেন সবদিক থেকেই দুর্গার আগমন বার্তাকে পৌঁছে দিল বাংলার ঘরে ঘরে। তারপর অবশ্য সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র, শচীন দেব বর্মণ, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, আরডি বর্মণ, আরতি মুখোপাধ্যায়- কাকে ছেড়ে কার নাম বলি! পুজোর আগে কিংবদন্তী এই সকল শিল্পীদের গান শোনার জন্য তাও আবার কলের গান থেকে, যেন উন্মুখ থাকত আপামর বাঙালি।
আজ রাজা নেই, রাজ্যপাট সেও গেছে চুকেবুকে। আজ থেকে দশ, কুড়ি বছর আগেও ছোটবেলাতে আকাশবাণীর মহালয়ার প্রভাতী অনুষ্ঠান শোনার জন্য ঘুম থেকে উঠে পড়তেন সকলে। কিন্তু আজ! যখন ইচ্ছে তখন শোনার সুবিধে করে দিয়েছে প্রযুক্তি। গ্রামোফোন থেকে ক্যাসেট, সেখান থেকে সিডি, ডিভিডি হয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য এক বিস্ময়কর জাম্প দিয়েছিল সভ্যতা। সেই কল্যাণের জন্য শুধু একদিন নয়, বছরের যে কোন দিন, যে কোন সময় আমরা শুনতে পারি বাংলা সঙ্গীতের স্বর্ণযুগের শিল্পীদের সব গান। শুধু তো একটা ক্লিকের ব্যপার। প্রযুক্তির উন্নয়ন কে না চায়! প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করেই তো এগিয়ে যাওয়া। তাই বলে অতীতের সব কিছুকে কোণঠাসা করে দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় আজ ধুলোয় মাখা নস্টালজিয়া। আর যে কারণে কলের গান শুধু ড্রয়িং রুমে শোভা বাড়ায়। অচলমুদ্রার মত পড়ে থাকে হারানো গৌরব নিয়ে, বাঙালির আবেগ নিয়ে। কলের গান থেকে যে আর গানটাই ভেসে আসে না…
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ