Market Battle
যতই থাকুক অনলাইন শপিংয়ের রমরমা, তবু রাস্তায় হেঁটে, ঘামে ভিজে, একে ঠেলে-ওকে ঠেলে নিজের হাতে পরখ করে শপিং করার মজাই আলাদা। বাঙালির এই অভ্যাসে আগেও মরচে পড়েনি। আর ভবিষ্যতেও পড়বে বলে মনে হয়না। তাই অ্যামাজন, ফ্লিপকার্ট বা মিশোর মতন একাধিক ওয়েবসাইট যখন পুজোর মরশুমে ছাড়ের পর ছাড় দিয়ে ক্রেতা ধরার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে, তখনো এই সব ই-কমার্স ওয়েবসাইটকে কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফেলে দিচ্ছে গড়িয়াহাট। পুজো আসলেই তিলোত্তমার বুকে হাতিবাগান, নিউ মার্কেটের মতন গড়িয়াহাটেও ভিড় উপচে পড়ে। মানুষের ঠেলাঠেলি, ট্র্যাফিকের ব্যতিব্যস্ততা সব যেন পুজো আসার আগেই ভালোরকম হাই জাম্প দেয়। কারণ, বেলুন থেকে বেনারসি সবই যে পাওয়া যায় এখানে। আর নিজের চোখে পরখ না-করে স্রেফ ই-কমার্সে ভরসা? তাহলে যে পুজোর গন্ধটাই ফিকে হয়ে যাবে। অতএব, গড়িয়াহাটে আসাটা মাস্ট। কারণ, ঐ যে বললাম, বাঙালির নিজের চোখে পরখ করে কেনার অভ্যাসে এখনো মরচে ধরে নি।
মনের মতন পোশাক, মনের মতন খাবার। পসরা সাজিয়ে বসে রয়েছেন বিক্রেতারা। কেউ রয়েছেন ঠাণ্ডা ঘরে। কেউ আবার রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই ফুটপাথে। সকলের উদ্দ্যেশ্য একটাই, আর সেটা বিক্রি। সূর্য ডুবলেই গড়িয়াহাটে ঢল নামে মানুষের। জেগে ওঠে কলকাতা। এক্কেবারে অন্যরকম। নাগরিক ব্যস্ততার এক অদ্ভুত ট্রানজিশন ধরা পড়ে, কাজ করে দুর্দান্ত একটা ভাইব। একের পর এক দোকান। আট থেকে আশি প্রত্যেকেরই চাহিদা সমান। আর এই সব চাহিদা পূরণ করতে লা-জবাব গড়িয়াহাট। অগুনতি মানুষের ভিড়ে যখন একেকজন বিক্রেতার মুখে হাসির ঢল ফ্রেমবন্দি হয় তখন বলার অপেক্ষা থাকে না, মা দুর্গা যখন আসেন, তখন আশীর্বাদ বর্ষায়। সারা বছরের পরিশ্রম যেন কয়েকদিনেই পুষিয়ে দেন দেবী।
গড়িয়াহাটের ঘিঞ্জি দোকান, বাংলায় দরদাম। একেক দোকানির একেকরকম গলায় ক্রেতাদের দোকানে টানার প্রতিযোগিতা। যেন কলকাতার বুকে গড়িয়াহাট এক আশ্চর্য ম্যাপ। ফুটপাথ জুড়ে বসে থাকা দোকানির ভিড়, বেলুনওলা, পকোরা বা চা-কফির হিড়িক- এই সবই গড়িয়াহাটকে নিয়ে যায় এক অন্য উচ্চতায়। হাল ফ্যাশন থেকে ট্র্যাডিশন- এই সবই গড়িয়াহাটে ছড়িয়ে রয়েছে মনের মতন করে। ক্রেতাদের কাছে তাই গড়িয়াহাট মানেই মনের মতন চাহিদা বুঝে কিনে নেওয়ার অপেক্ষাটুকু শুধু। ট্র্যাফিকের হলদে, সবুজ, লাল আলোর সঙ্গেই মিশে যায় হাজার হাজার দোকানের আলো। তার সঙ্গে দারুণভাবে খাপ খেয়ে যায় মানুষের মুড। কেউ অস্থির, কেউ ক্লান্ত। কারুর উচ্ছ্বাস, কেউ ভ্রান্ত। গড়িয়াহাটে পুজোর আগে শপিংয়ের ভিড় টেক্কা দেবে অনলাইন ব্যবসাকেও।
একটা সময় ছিল যখন শপিং আর মার্কেটিংয়ের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম ফারাক অনুভব করতেন বাঙালিরা। মার্কেটিং বললেই এসি রুম বা ঝাঁ চকচকে সাজানো শপিং মল- সবকিছুই পরিপাটি করে সাজানো। কিন্তু গড়িয়াহাট মার্কেটে উৎসবের আবহে এক অন্যরকম ভাইব্রেশন ঘুরে বেড়ায়। নাই বা থাকল ঝাঁ চকচকে ব্যপার। নাই বা থাকল ক্রেতাদের পরিপাটিভাবে কেনাকাটার ট্র্যাডিশন। চারিপাশে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক, ঠেলাঠেলি, মানুষের যে প্রাণোচ্ছ্বল ব্যপার- এই পুরোটাই গড়িয়াহাট মার্কেটে সৌন্দর্যকে কোথায় গিয়ে যেন মিশিয়ে দেয় তিলোত্তমার সঙ্গে। বিক্রেতার মুখে হাসি, দুর্দান্ত ব্যবসা, ফুরিয়ে যাওয়া দোকানের স্টক- এই সবকিছুই তুলে ধরে গড়িয়াহাটের অদ্ভুত গল্পগাথাকে। সেটা অনলাইন মার্কেটে অভ্যস্ত ক্রেতার কাছে অলৌকিক মনে হলেও, কলকাতার কাছে যে এটাই ভীষণ বাস্তব। আর দুর্গা পুজোর আগে তো বটেই।