Daily
প্রিয় পাঠক , প্রথমেই একটা প্রশ্ন আপনাদের জন্য। আপনি যদি গাড়িপ্রেমী হন, তাহলে কোন কোন দিকগুলো সবার আগে মাথায় রাখবেন? সেটা প্রথমেই বলি, জানান আমাদের কমেন্ট বক্সে। কিন্তু সকল গাড়িপ্রেমীদের যদি বিশেষ কোন একটি ব্র্যান্ডের গাড়ির কথা বলা হয়, তাহলে নির্দ্বিধায় তাঁদের হাসি চওড়া হবে। সাবেকিয়ানার সঙ্গে ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার চরম মিশেল যদি কোন একটি গাড়ি ব্র্যান্ড করতে পারে, তবে সেটা আর কেউ নয় রোলস রয়েস। যে কোম্পানি একশো বছরের বেশি সময় ধরে নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু এক জায়গায় ধরে রেখেছে। তার জন্য রোলস রয়েস কোনদিনই প্রতিযোগিতায় নামে নি গাড়ি বাজারে। এটাই তাদের আভিজাত্য, এটাই তাদের আইডেন্টিটি। কোটি কোটি টাকা খরচ হয় একটি গাড়ি কিনতে। সুতরাং রোলস রয়েস যে সবদিক থেকেই অন্যান্য গাড়ি কোম্পানিকে কিছুটা ফেলে দেবে, সেটা আর নতুন কী? তবে একটা কথা কী জানেন? আপনি যতই গাড়ি প্রেমী হন না কেন, রোলস রয়েস সবাই কিনতে পারেন না। এভাবেই তিলে তিলে নিজের ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করেছে সংস্থাটি। কিন্তু আপনার মনে হতেই পারে যে, যেখানে অন্যান্য প্রথম সারির গাড়ি সংস্থাগুলি দীর্ঘ প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে, সেখানে প্রতিযোগিতা ছাড়া এভাবে নির্দ্বিধায় কিভাবে রোলস রয়েস নিজের পজিশন একচুল নড়াতে পারেনি? আসুন আজকের প্রতিবেদনে আলোচনা করা যাক সেটা নিয়েই। বলাই বাহুল্য, আজকের প্রতিবেদন কিন্তু হতে চলেছে যারা গাড়িপ্রেমী তাদের জন্য খুব স্পেশ্যাল।
১৯০৪ সালে রোলস রয়েসের চাকা গড়াতে শুরু করে ইংল্যান্ডের দুই ব্যক্তির হাত ধরে। চার্লস রোলস এবং হেনরি রয়েস। রোলস রয়েস সেই সময় রেসিং ড্রাইভার হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় বিষয় হল, রোলস নিজে ছিলেন একজন কার ডিলার। অন্যদিকে হেনরি রয়েস ছিলেন একজন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি গাড়ি এবং প্লেনের ডিজাইনিং-এর জন্য যুক্তরাজ্যে যথেষ্ট হইচই ফেলে দেন। এই দুজনের মধ্যেই একটা বিজনেস এগ্রিমেন্ট হয়। সেই এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ঠিক করা হয়, রয়েস গাড়ি ম্যানুফ্যাকচার করবেন। আর রোলস সেটা বিক্রি করবেন। সেই মতনই ১৯০৪ সালে রোলস রয়েস কোম্পানি তাদের প্রথম চার চাকা যান বাজারে নিয়ে আসে। এই ক্লাসিক লুক আজকের দিনেও সমান জনপ্রিয়। রোলস রয়েস এই গাড়িটির নাম দেয় রোলস রয়েস ১০ এইচপি। সেই সময় এই গাড়িটি সর্বোচ্চ ৬৩ কিমি প্রতি ঘণ্টায় ছুটতে পারত। গাড়ির দাম ১৯০৪ সালে রাখা হয়েছিল ৩৯৫ ইউরো। এরপর ১৯০৬ সালে প্রথম দুজনে মিলে রোলস রয়েস কোম্পানির গোরাপত্তন করেন। এবং ১৯০৭ সালে তারা লঞ্চ করে রোলস রয়েস সিলচার ঘোস্ট। সেই সময় এই গাড়িটি ছিল বিশ্বের সেরা গাড়ির তালিকায়। এরপর ১৯২৫ সালে রোলস রয়েসের হাত ধরে লঞ্চ করে রোলস রয়েস ফ্যান্টম। কিন্তু শুরুর দিন থেকে এই কয়েক বছরের মধ্যে রোলস রয়েস নিজেকে শুধু কার ম্যানুফ্যাকচারিং-এর মধ্যেই আটকে রাখেনি। বরং এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ারিং-এ রোলস রয়েস নিজের অবদান রাখে ১৯২০ সালে। আর অন্যদিকে স্পোর্টস কার মেকার বেন্টলিকে কিনে নেয় রোলস রয়েস। এরপর ১৯৩৬ সালে এই সংস্থার হাট ধরে বাজারে আসে ফ্যান্টম ৩। এই গাড়িতে ভিটুয়েলভ ইঞ্জিন সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয়। এরপর কিন্তু রোলস রয়েস বেশ কিছু লাগজারি গাড়ি বাজারে নিয়ে আসতে শুরু করে। এরপর ইংল্যান্ডের ডিফেন্স কোম্পানি ভিকারস সংস্থাটি কিনে নেয় ৯৩৩ মিলিয়ন ডলারে। লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে রোলস রয়েস প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৮৫ সালে। তারপরেই ভিকারস রোলস রয়েসকে বেচে দেবার পরিকল্পনা করে। সেই সময় এগিয়ে আসে আরও দুই কার ম্যানুফ্যাকচারিং জায়ান্ট বিএমডব্লিউ এবং ফক্সওয়াগন। সেই সময় বিএমডব্লিউ ৩৪০ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে নেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু ফক্সওয়াগন ৪৩০ মিলিয়ন ইউরোর পরিবর্তে রোলস রয়েস নিজেদের হাতে নিয়ে নেয় তারা। এরপর অবশ্য বিএমডব্লিউ ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচা করে নিজেদের সাবসিডার হিসেবে রোলস রয়েসের ব্র্যান্ড নেম আর লোগো নিজেদের হাতে তুলে নেয় তারা। তারপর থেকে এখনো পর্যন্ত রোলস রয়েস নিজেদের কৌলীন্যে সামান্যতম আঁচ লাগতে দেয়নি। খুব কম সংখ্যক গাড়ি ফি বছরে বিক্রি করলেও, ব্র্যান্ড ভ্যালুর নিরিখে আজ রোলস রয়েস বিশ্বের অন্যতম দামি একটি ব্র্যান্ড। এবার বলি তার কারণ কী।
রোলস রয়েসের একটি গাড়ির সর্বনিম্ন দাম ৫ কোটি টাকা মতন। একটি গাড়ির এমন আকাশছোঁয়া দামের পরেও কেন রোলস রয়েসের আভিজাত্য একটুও কমেনি? তার জন্য কি শুধুই ইতিহাস দায়ী? তবে বলি একেবারেই না। এই দামের অন্যতম কারণ হল রোলস রয়েসের রঙ। সত্যি বলতে কী, রোলস রয়েসের গাড়ির জন্য ৪৪ হাজারের বেশি রং অ্যাভেলেবল রয়েছে। যা একজন কাস্টমার নিজের পছন্দমত ঠিক করতে পারবেন। বলা হয়, কাস্টমারের জন্য তারা রং নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেও পিছ পা হয়না। এমনকি একজন কাস্টমার যদি কোন এক রং-এর গাড়ি নেন, তাহলে অন্য কাস্টমার সেই রং-এর গাড়ি নিতে পারবেন না। আর নিলেও তাঁকে সবার আগে সেই কাস্টমারের থেকে পারমিশন নিতে হবে। রোলস রয়েস অবশ্য কখনোই একে পেইন্ট জব বলে না। বরং সংস্থাটি এই প্রক্রিয়াকে বলে থাকে সারফেস ফিনিশ। বলা হয়, একটি গাড়িতে নাকি সাত বার রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। আর যত বেশি প্রলেপ, তত বেশি দাম।
এখানেই শেষ নয়। রোলস রয়েস রং-এর সঙ্গে মনে করলে গ্রাহকের পছন্দমতন হিরে, সোনা বা অন্যান্য পদার্থের মিশ্রণ তৈরি করতে পারে। যা গাড়ির জৌলুশ বাড়াতে পারে আরও কয়েক গুণ। আর রোলস রয়েসে যে নিখুঁত পেন্ট স্ট্রাইপ থাকে সেটা করে থাকেন একজন মাত্র ব্যক্তি। তাঁর নাম মার্ক কোর্ট। বলা হয়, সংস্থায় কোর্ট হচ্ছেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই কাজ করতে পারেন। তার জন্য মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়।
এবার আসা যাক ইন্টিরিয়রের কথায়। গ্রাহক চাইলে তাঁর পছন্দের ইন্টিরিয়র তৈরি করে দেবে সংস্থার দক্ষ কর্মীরা। আর এখানেই একটা বিষয়। এই গাড়ির অধিকাংশ পার্টস কিন্তু হাতে তৈরি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো যন্ত্রের ব্যবহারও করা হয়না। শুধুমাত্র চোখের আন্দাজ এবং অভিজ্ঞতার ওপরেই ভরসা করেন কর্মীরা। দক্ষ ক্র্যাফটসম্যানদের এই সব কারণের জন্যই রোলস রয়েসের ফিনিশিং সবাইকে ছাপিয়ে যায়। এছাড়া গাড়ির ভেতরে যদি রাতের আকাশ দেখতে হয়, সেই অনুভূতিও আপনাকে দেবে রোলস রয়েস। যাকে বলা হয় স্টার লাইট ফিচার। গ্রাহকরা চাইলে নিজেদের পছন্দমতন স্টারলাইটের অপশন দিতে পারবেন। একেকটি গাড়িতে স্টারলাইট বসাতে সময় লেগে যায় প্রায় ১৬ ঘণ্টা মতন। এছাড়া রয়েছে এই গাড়ির টায়ার। সেটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়, যাতে গাড়ি চলার সময় শব্দ কম তৈরি হয়। এমনকি গাড়ির ভেতরে ৩০০ পাউণ্ডের অ্যাকাউস্টিক ইনস্যুলেশন ব্যবহার করে থাকে। যাতে বাইরের শব্দ গাড়ির ভেতরে না-আসে। আর হচ্ছে চাকায় থাকা লোগো। গাড়ি চলার সময় বা দাঁড়িয়ে থাকার সময় যাতে লোগোটি সবসময় সোজা থাকে, সেদিকেই খেয়াল রাখা হয় সবচেয়ে বেশি।
বন্ধুরা, রোলস রয়েস গাড়ির আভিজাত্য জড়িয়ে রয়েছে ব্রিটিশ রাজপরিবারের সঙ্গে। সেই ইতিহাসের পথ ধরে আজ তারা গোটা বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড। ২০১৯ সালে সংস্থাটি মোট ৫,১৫২টি গাড়ি তৈরি করেছিল। আর ২০২২ সালে সংস্থাটি ৬ হাজারের একটু বেশি গাড়ি প্রস্তুত করেছে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন যে, রোলস রয়েস কখনোই আগে থেকে কোন গাড়ি তৈরি করে না। বরং গ্রাহকের থেকে গ্রিন সিগন্যাল পেলে তবেই নতুন গাড়ি তৈরিতে হাত দেয় রোলস রয়েস। সবথেকে অবাক করা তথ্য হল, ২০২২ সালে ৬ হাজারের বেশি গাড়ি তৈরি করে এতো বছরের ইতিহাসে রেকর্ড তৈরি করেছে রোলস রয়েস। জানা গিয়েছে, ২০২২ সালে রোলস রয়েসের রেভেন্যু ছিল ১৩,৫২০ মিলিয়ন পাউণ্ড। তাহলে কী বুঝলেন বন্ধুরা? শুধু টাকা থাকলেই হবে না। রোলস রয়েস যদি আপনাকে নিতে হয়, তার জন্য গ্রাহকের থাকতে হবে দারুণ নান্দনিক বোধ। আর এই সব মেলাতে পারলে তবেই আপনার সামনে হাজির হবে আপনার প্রিয় কার ব্র্যান্ড রোলস রয়েস।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ