Trending

হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা এই মণিপুর, বিশ্বজয়ী মেরি কমের রাজ্য নয়। সংখ্যালঘুর উপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্য কায়েমির এই মণিপুর জওহরলাল নেহেরুর স্বপ্নের জুয়েল অফ ইন্ডিয়া নয়। থামতে না চাওয়া অশান্তির এই মণিপুর মীরাবাঈ চানুর রাজ্য নয়। প্রতিশোধ নেওয়ার রক্তাক্ত লড়াইয়ের এই মণিপুর আয়রন লেডী ইরিওম চানু শারমিলিয়ার রাজ্য নয়। হতে পারে না। কেন? কারণ এই বীরাঙ্গনাদের রাজ্যে আজ জয়ী হচ্ছে কাপুরুষতা। বীর চিত্রাঙ্গদার রাজ্যে বিবস্ত্র আজকের দ্রৌপদীরা। লজ্জায় মুখ ঢাকছে গোটা দেশ। কিন্তু এই মুখ ঢেকে, চুপ করে থেকে, ছিঃ ছিৎকার করে আর কত দিন? অবশ্য আপনাদের আর দোষ কী বলুন! স্বয়ং বিশ্বগুরু বলে যিনি নিজেকে মানেন, তিনিও তো গত ৭৮ দিন ধরে একদম চুপ। তারপর যদিও বা মুখ খুললেন…
দুই জনগোষ্ঠীর আক্রোশের জেরে আড়াইমাস পরও মণিপুর রণক্ষেত্র। মুখে কুলুপ এঁটেছে সরকার। হিংসা কি যথেষ্ট ছড়ানো হয়নি? ঘটনার ৭৮ দিন পরেও ৮০০ জনের ভিড় থেকে মাত্র ৬ জন গ্রেফতার হল। বাকীরা শাস্তি পেল না কেন? দেশের আইন তো অন্ধ নয়। তাহলে এখনও আইনানুগ কোন ব্যবস্থা নিতে এত দেরী কেন? আপনারা বলতেই পারেন যে মণিপুর জুড়ে এই যে হিংসার বাতাবরণ তা উত্তর পূর্বের অসংখ্য সমস্যার একটি। দেখুন এই হিংসার পরিবেশ নানান সমস্যার একটা ফল- কোন কারণ নয়। সেটা ঠিক। কিন্তু এইরকম কুরুচিকর লজ্জাজনক পরিস্থিতি কারও কাছেই অভিপ্রেত নয়। সুতরাং সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আপনারা প্রশ্ন করতেই পারেন, দেশের এত সমস্যা থাকতে হঠাৎ মণিপুর নিয়ে মাথাব্যথা কেন? কারণ মণিপুর আসলে একটা নমুনা। মডেল। দৃষ্টান্ত। কীসের জানেন? সংখ্যালঘুর ওপর সংখ্যাগুরুর আধিপত্যকায়েমির। ছোট্ট এই রাজ্যটিতে মেইতেই, নাগা আর কুকিদের এই সংঘাত, থামতে না চাওয়া অশান্তি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার চরমতম পরিণতি কী হতে পারে। ‘অখণ্ড ভারত’ কীভাবে নিমেষের মধ্যে খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে পারে। তাই মানবতার খাতিরে মণিপুর নিয়ে মুখ খুলতেই হচ্ছে। আর এসব যদি বাদ দেই তবুও মণিপুর নিয়ে কথা বলাটা সমীচীন কারণ মণিপুর হচ্ছে ভারতের অন্যতম প্রধান জিয়নকাঠি। মণিপুর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতকে বেঁধে রাখার জিয়নকাঠি। কাজেই মণিপুরের শান্ত হওয়াটা জরুরী।
মণিপুর হচ্ছে ভারতের সেই রাজ্য যে মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগ করে। ১৯৪৭ থেকে ২০২৩- কতগুলো বছর? প্রায় ৭৫ বছর রাইট? স্বাধীনতার পর ৭৫ বছর পেরল। অথচ মণিপুরের মতো একটা ইম্পরট্যান্ট স্টেট ইনফাস্ট্রাকচারাল ডেভলপমেন্ট থেকে ব্রাত্য থেকে গেল। কেন? মনিপুরে কোন রেলওয়ে কানেক্টিভিটি নেই। সেটা জানেন তো? ওষুধ হোক বা মুদি সদাই, জামাকাপড় যাবতীয় যা কিছু বাই রোড মনিপুরে পৌঁছয়। আর সেই গেটওয়ে দীর্ঘ ৫৪ দিন বন্ধ ছিল অশান্তির কারণে? সরকার তখনও নিশ্চুপ! আচ্ছা সরকার কি এটা জানেন না যে লজিস্টিক বা ইনফাস্ট্রাকচারাল ডেভলপমেন্ট যেকোনো যুদ্ধে দাঁড়ি টানতে পারে?
১৯৬২-এর ইন্দো-চায়না যুদ্ধ ভারত হেরেছিল কারণ ভারত লজিস্টিকালি তৈরি ছিল না। তারপর লাদাখ সীমান্তে প্রচুর ডেভলপমেন্ট হয়েছে। আরে বাবা মানুষ তো ঠেকেও শেখে নাকি? মণিপুর মায়ানমার বর্ডার শেয়ার করে। মায়ান্মারে গৃহযুদ্ধ লেগেই থাকে। মণিপুরও এখন প্রচণ্ড উত্তপ্ত। আজ ভায়লেন্স দেশের ভিতরে হচ্ছে। কিন্তু কাল যদি কোন ফরেন থ্রেট আসে, তখন?
এই কাদা ছোড়াছুঁড়ির মাঝে একটা বিষয় আপনারা নজর করলেন কি না জানি না, তবে আমার যেটা মনে হয়, আদিবাসীরা সিস্টেমকে বা অথরিটিকে ভরসা করতে পারছে না। এটা কিন্তু ভারতের কাছে একটা মারাত্মক থ্রেট। চিন এর সুযোগ নেবে না তো?
দেখুন কার দোষ আর কে ঘটনার শিকার সেটা বিচার করার সময় রয়েছে। তবে যেটা ইমিডিয়েট নিড সেটা হচ্ছে উত্তর-পূর্ব ভারতের ডেভলপমেন্ট। মণিপুরের ডেভলপমেন্ট। নাহলে আরও বড়সড় অঘটনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।
দর্শন বা ইতিহাস বলছে কোন ঘটনাই এমনি এমনি হয় না। কাজেই মণিপুর শান্ত হওয়ার পাশাপাশি ইনফাস্ট্রাকচারাল ডেভলপমেন্ট প্রয়োজন। এই উত্তাল পরিস্থিতির সূত্র জানতে একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। যেই দুই জনজাতির আক্রোশে আজ মণিপুর উত্তপ্ত,এক সময় তারাই গলায় গলায় বন্ধু ছিল। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগের সময় মণিপুর রাজতন্ত্র স্বীকার করে একা পথ চলার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তৎকালীন বার্মা সেটা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। শুরু হয় অ্যাটাক। ব্রিটিশ ইন্দিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে তারা ভারতের মানচিত্রে নাম লেখায়। পরিবর্তে ব্রিটিশ তাদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একদল আদিবাসী সম্প্রদায়কে সেখানে ইন্ট্রোডিউস করে। ঠিক হয় তারা পাহাড় এবং জঙ্গলে থাকবে যা মণিপুরের সীমান্ত বরাবর। আর মেইটি সম্প্রদায় যারা মণিপুরের অ্যানসেস্টর তারা সমতলে থাকবে। কিন্তু ব্রিটিশ রাজের সিদ্ধান্তে যে ডিপ্লমেসি ছিল। কারণ তারা বলেছিল, কুকি চাইলে মণিপুরের সমতলভুমিতে জমি কিনতে পারে। কিন্তু মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ কোনভাবেই পাহাড় বা জঙ্গলে জমি কিনতে পারবেন না। অতয়েব তারা প্রপার ম্যানেজমেন্ট ডেভলপ করতে ব্যর্থ।
নর্থ-ইস্টে প্রচুর কমিউনিটির মানুষের বাস। আর এটাই সেখানকার বিউটি। তাই সরকারকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সুস্থ সবল ভাবে আলচনায় বসতে হবে। আর বাইরে থেকে কোনরকম উস্কানি আসলে সেটা যাতে আর কোনরকম অপ্রিতিকর পরিস্থিতি তৈরি না করে সেটাও ব্যাল্যান্স করাও সরকারের দায়িত্ব। ডাইভারস গ্রুপগুলো যেন সেখানে সেফ থাকে সেটা এনশিওর করার রেস্পন্সিবিলিটি মণিপুর সরকারের। কারণ এধরনের ঘটনা কারও কাছেই অ্যাক্সেপ্টেড নয়। আর সেটা একজিকিউট করতে না পারলে ভারত সরকার এবং ব্রিটিশ সরকার দুজনের মধ্যেই কোন পার্থক্য থাকবে না।
আজ মণিপুরের এই পরিস্থিতি সত্যি সিস্টেমের ডার্ক সাইডটা তুলে ধরে। মানুষের প্রতি মানুষের এমন ব্যবহার প্রশ্ন করে, মানবিকতার ছিটেফোঁটাও কি নেই? ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ঘর ছেড়েছেন। স্কুল, কলেজ গুলো রিফিউজি ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। ১০০-এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আগুনে ঝলসে যাচ্ছে এমএলএ-দের ঘর। সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে। আর এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে আমার ইউনিটি ইন ডাইভারসিটির বড়াই করি? কোন ইউনিটির বড়াই করি আমরা? এত চেষ্টা সত্ত্বেও মণিপুরে শান্তি আনা গেল না কেন? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও মণিপুরের কানেক্টিভিটি ডেভলপড হল না কেন? নাকি বর্ডার এরিয়ার এই সমস্যাগুলোকে ইচ্ছে করেই সমধান করা হচ্ছে না? তাহলে এই সব কিছু কি আদলে একপ্রকার আইওয়াশ? আমার তরফ থেকে থাকলো। আপনাদের তরফে কোন বক্তব্য থাকলে জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে দেখতে থাকুন বিজনেস প্রাইম নিউজ। জীবন হোক অর্থবহ।