Trending
প্রিয় দর্শক, ভারত এবং চিনের মধ্যে সীমান্তে সংঘর্ষ নতুন কিছু নয়। মাঝেমধ্যেই ভারত সরকারের ঘুম উড়িয়ে দেয় লাল ফৌজ। কখনো চিনা সেনাদের অতর্কিত হামলা চালানোর প্রয়াস, কখনো স্যাটেলাইটে ধরা পড়ে সীমান্ত ঘেঁসে তৈরি হওয়া আস্ত একটা গ্রাম। কিন্তু লাল ফৌজের অকারণ উঁকিঝুঁকির কারণ? খেয়াল রাখবেন, চিনা সৈন্যরা অকারণে কিছু করে না। তাদের সবসময়ই লক্ষ্য থাকে কিভাবে অন্য দেশে অশান্তি তৈরি করা যায়। এবং নিজেদের কার্যসিদ্ধি করা যায়। ৩৫০০ কিমি-এর সীমান্ত রেখার ওপাড়ে দাঁড়িয়ে লাল ফৌজ ভারতের কয়েকটি জায়গা নিজেদের দখলে রাখতে চায়। তেমনই একটি জায়গা হল অরুণাচল প্রদেশ। ভৌগলিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে উত্তর-পূর্ব ভারতের এটা সবথেকে বড় রাজ্য। চিন বহু বছর ধরেই অরুণাচল নিজেদের কব্জায় আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, অরুণাচল প্রদেশকে নিজেদের বলেও দাবি করে আসছে চিন। আর যে কারণে একে তারা দক্ষিণ তিব্বত বলেও দাবি করে থাকে। এবার তিব্বত নিজেদেরকেও তো স্বতন্ত্র বলে দাবি জানিয়ে এসেছিল। চিন সরকার তিব্বতের সেই দাবিকে পাত্তাও দেয়নি। সে যাই হোক। এখন ভারতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে অরুণাচল প্রদেশ। যা ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, কিন্তু সেটা মানতে নারাজ চিন। কেন, ঠিক কী কারণে অরুণাচলের দাবি জানাচ্ছে লাল ফৌজ?
ভারত এবং চিনের মধ্যে সীমারেখা ৩৫০০ কিমি-এর মতন। আর স্যর ম্যাকমোহন কর্তৃক অরুণাচল প্রদেশ এবং তিব্বতের মধ্যে যে সীমারেখা টানা হয়েছে, সেটাই হচ্ছে ম্যাকমোহন লাইন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, চিন ম্যাকমোহন লাইনকে শুরু থেকেই মেনে আসতে চায় নি। কিন্তু কেন? তাহলে যাওয়া যাক অনেকটা পিছনে। ঝামেলার সূত্রপাত ১৯১৪। সেই বছর ব্রিটিশ, চিন এবং তিব্বতের মধ্যে সিমলায় একটা কনফারেন্স হয়। সেখানে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এবং তিব্বতের মধ্যে ৮৯০ কিমি লম্বা সীমারেখা টানা হয়। তাওয়াং চলে আসে ভারতের মধ্যে। কিন্তু বলা হচ্ছে, কনফারেন্সের নাকি কোন লিখিত রেকর্ড নেই। সেই সময়, চিনের প্রতিনিধিরা সই সাবুদ তো করেছিলেন, কিন্তু পরে ডিটেল ম্যাপে আর সই করেন নি তারা। চিনের দাবি, তাদের অন্ধকারে রেখেই নাকি এই ম্যাকমোহন লাইন টানা হয়েছে। আর যে কারণে চিন ম্যাকমোহন লাইনের অস্তিত্বকে স্বীকার করতেই রাজি নয়। একইসঙ্গে বলে, তিব্বতের কোন ব্যপারে সই-সাবুদ করার অধিকার নেই। কারণ তিব্বত নিজেই চিনের অধীনে। আর এখন তারা অরুণাচল প্রদেশকে নিজের দখলে আনতে চায়, দক্ষিণ তিব্বত বলে। প্রথম থেকে চিন অরুণাচল প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত তাওয়াং-কে নিজেদের বলে দাবি করে আসছিল। এখানেই বলি, তাওয়াং অরুণাচল প্রদেশের খুব সুন্দর একটি জায়গা। হিমালয়ের কোলে অবস্থিত তাওয়াং-এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০ হাজার ফুট উঁচুতে। ষষ্ঠ দলাই লামার জন্মস্থান হল তাওয়াং। এছাড়া, তিব্বত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ শহর। কারণ, তাওয়াং-এ বৌদ্ধ মন্দির যুগ যুগ ধরে ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারকে জিইয়ে রেখেছে।
১৯১২ সাল পর্যন্ত ভারত এবং তিব্বতের মধ্যে কোন স্পষ্ট সীমারেখা টানা ছিল না। সেখানে না ছিল কোন মোগল শাসকের দরবার, না ছিল ইংরেজদের নজর। কিন্তু তাওয়াং-এ যখন বৌদ্ধ মন্দির পাওয়া গেল, তারপর থেকেই শুরু হল সীমারেখা টানার তোরজোড়। ১৯১৪ সালে সিমলায় সীমারেখা নির্ধারণ করা গেল। ১৯৫০ সালে চিন তিব্বতকে পুরোপুরিভাবে নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল। চিন চেয়েছিল, তাওয়াং যেন এদের দখলে চলে আসে। যা তিব্বতি বৌদ্ধদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বন্ধুরা, ১৯৪৯ সালে মাও-ৎসে-দং এর হাত ধরে তৈরি হল পিপলস রিপাবলিক অফ চায়না। ১ এপ্রিল ১৯৫০ সালে ভারত একে মান্যতা দিল। ১৯৫০ সালেই তিব্বতকে নিজেদের দখলে আনার জন্য চিন হামলা চালাতে শুরু করল। ১৯৫৪ সালে ভারত তিব্বত নিয়ে চিনের আগ্রাসনকে স্বীকার করে নিল। অর্থাৎ তিব্বত যে চিনের অংশ সেটা ভারত নির্দ্বিধায় মেনে নিল। তার মানে ভাবুন, ১৯১৪ সালে সীমারেখা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেলেও, ১৯৫৪ সালে ভারতের এই মেনে নেওয়াটাই নতুন করে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। ১৯৫৪ থেকে ১৯৫৭ সালের মধ্যে চিনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চাউ এন লাই চারবার ভারত ভ্রমণ করলেন। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু চিন ভ্রমণ করলেন ১৯৫৪ সালে। কিন্তু বিষয়টা অন্যদিকে ঘুরে গেল। এতদিন পর্যন্ত তিব্বতের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুব গভীর ছিল। কিন্তু এরপর থেকে চিনের দখলে পুরোপুরিভাবে চলে গেল তিব্বত। তারপর থেকেই চিনের নজর পড়ে ভারতের এই সীমারেখায়। ১৯৫৭ সালে চিন আকসাই চিনে ১৭৯ কিমি রাস্তা তৈরি করে। ১৯৬২ সালে যখন ভারত চিন প্রথম যুদ্ধ হয়, সেই যুদ্ধে চিন জয় লাভ করে। তারপরেও চিন পিছিয়ে যায়। কিন্তু চিনের নজর আটকে থাকে অরুণাচলেই।
এখানেই আরেকটা তথ্য দিয়ে রাখি, চিন যখন তিব্বত আক্রমণ চালিয়েছিল, সেই সময় তিব্বত ছেড়ে ভারতে পালিয়ে আসেন বৌদ্ধগুরু দলাই লামা। তিব্বতের লাসা থেকে তিনি পালিয়ে আসেন। প্রায় ১৫ দিন হাঁটার পর তিনি পৌঁছন ভারতে। ১৯৫৯ সালের ২৯ এপ্রিল তৈরি করা হয় সেন্ট্রাল টিবেটান অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হিমাচল প্রদেশে তৈরি করা হয়। আর এই অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং দলাই লামার কানেকশন দেখে চিনের ভয়, ভারত হয়ত নিঃশব্দে তিব্বতে টিবেটান ইন্ডিপেন্ডেন্স মুভমেন্ট চালাতে পারে। চিন মনে করে, ভারতের জন্যই তিব্বত ইস্যু এখনো আন্তর্জাতিক মহলে কোন সমাধানের জায়গায় পৌঁছতে পারেনি। খেয়াল করলে দেখবেন, দলাই লামা একবার অরুণাচল প্রদেশে যাত্রা করেছিলেন। যার ভালোরকম বিরোধিতা দেখিয়েছিল চিন। এছাড়া আরেকটা কারণ হল, চিন মনে করে অরুণাচল প্রদেশ এমন একটি স্ট্র্যাটেজিক জায়গায় অবস্থিত, যে ভারত মনে করলে সেখান থেকেই ব্রহ্মোস বা ইন্টার কন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল ছাড়তে পারে। আর সেটা হয়ত সরাসরি গিয়ে আঘাত হানতে পারে চিনের ওপর।
চিন অরুণাচল প্রদেশের ১৫টি জায়গার নাম পাল্টে দিয়েছে। চিনের মিডিয়া গ্লোবাল টাইমসের মতে অরুণাচল প্রদেশের নাম হয়েছে জাংনান। আর এবারেও যখন চিন অরুণাচল প্রদেশের জায়ার নামগুলো পাল্টে দেবার বিষয়টা সামনে আনল, তখন হোয়াইট হাউজ থেকেও এলো কড়া বিরোধিতা। হোয়াইট হাউজ সাফ জানিয়ে দিল, অন্য দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাথা গলানো ঠিক নয়। কিন্তু সেই কথা চিন শুনছে কী? যাই হোক। চিন হাজার চেষ্টা করে গেলেও লাভের লাভ কিছুই হবে না। কারণ, অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অংশ ছিল, আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ