Trending
মোবাইল প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম পরিচিত নাম নোকিয়া। এই কোম্পানি সর্বপ্রথম পোর্টেবল মোবাইল সেট বাজারে আনে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত যে কোম্পানি বিশ্বের ৭০ শতাংশ মার্কেট দখল করেছিল, সেই কোম্পানি কেন অন্যান্য মোবাইল প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ল? নমস্কার বন্ধুরা আমি পৌলোমী, আজ আমরা আলোচনা করব নোকিয়া কোম্পানির ব্যবসার কেস স্টাডি নিয়ে।
বহু বিজনেস অ্যানালিটিসের ধারণা যে, গুগলও অ্যাপলের জন্য নোকিয়া ব্যবসায় ফ্লপ করে। কিন্তু আসল সত্যি সেটা নয়। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার আগে আমাদের জানতে হবে নোকিয়ার উত্থান সম্পর্কে।
আজ থেকে প্রায় আনুমানিক দেড়শ বছর আগে ফিনল্যান্ডের fredrik idestam নামক এক ব্যক্তি সেখনে পেপার মিল ব্যবসা শুরু করেন। ক্রমশই সেই ব্যবসার গাড়ি দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করে। এক থেকে দুই, দুই থেকে তিন- এইভাবে একে একে বাড়তে থাকে পেপার মিলের সংখ্যা। এরপর তিনি একটি বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রদানকারী কোম্পানি খোলার পরিকল্পনা করেন। সেই কোম্পানির নাম ছিল নোকিয়া ab. এরপর নোকিয়া ধীরে ধীরে অন্যান্য সেক্টরে নিজেদের এক্সপ্যান্ড করার চিন্তা ভাবনা করেন। ধীরে ধীরে আত্মপ্রকাশ করে নোকিয়া কেমিক্যালস, নোকিয় টিউবস, নোকিয়া গ্যাস, নোকিয়া প্লাস্টিক ইত্যাদি। এরপর ১৯৬০ সালে নোকিয়া প্রথম টেলিফোন ব্যবসায় নিজের নাম লেখায়। সেই সময়ে টেলিফোন ছিল খুবই এক্সপেন্সিভ। সাধারণ মানুষের কাছে সেইভাবে টেলিফোনের কোন অ্যাক্সেস ছিল না।
১৯৮০ সালে নোকিয়া তাদের ওয়ানজি টেকনোলজির উপর কাজ করতে শুরু করে। এবং মোবিরা সেনাটর নামক একটি রেডিও ফোন লঞ্চ করে। ১০ কেজি ওজনের এই ফোনটি ছিল মূলত কার ফোন। এরপর ১৯৮৭ সালে সর্বপ্রথম নোকিয়া পোর্টেবল মোবাইল ফোন বাজারে নিয়ে আসে। সেই দুনিয়ায় যার টেলিফোন জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। কিন্তু এই মোবাইল ফোনের দাম ছিল এতটাই বেশি যা মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে ছিল।
নোকিয়ার টেলিফোন ব্যবসায় সবথেকে বড় জোয়ার আসে ১৯৯৪ সালে। তারা নোকিয়া ২১১০ নামক একটি হ্যান্ডসেট বাজারে আনে। যা কোম্পানির প্রত্যাশা অতিক্রম করে যায়। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে ৪ কোটি অর্ডার আসে নোকিয়া ২১১০ এর। মোবাইল দুনিয়ায় তখন একটাই নাম, নোকিয়া – নোকিয়া & নোকিয়া.
কিন্তু আজ কার্যত বাজার থেকে হারিয়ে গেছে নোকিয়া। কিন্তু কেন ?
২০০৩ সাল থেকে ২০০৫ সালের সময়সীমায় নোকিয়া ১১০০ & নোকিয়া ১১১০ বাজারে আসে। তৎকালীন এরিকসন, মোটোরোলাকে কার্যত ১০ গোল দিয়ে বাজারে একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম করে নোকিয়া। এরপর কোম্পানিতে ম্যানেজমেন্ট টার্নঅ্যারাউন্ড ঘটে, যা কোম্পানির খারাপ সময়কে ডেকে আনে। কিপ্যাড ফোনের পাশাপাশি নোকিয়া সর্বপ্রথম টাচ স্ক্রিন ফোন ও ট্যাব বানায়। কিন্তু তৎকালীন সময় সংস্থা কখনোই সেই প্রোডাক্ট বাজারে আনবার ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি। যার ফলে চরম খেসারত দিতে হয় কোম্পানিকে।
২০০৭ সালে স্টিভ জবস এর হাত ধরে অ্যাপেল বাজারে প্রথম মোবাইল লঞ্চ করে। যার নাম আইফোন। যা কার্যত বিপ্লব সৃষ্টি করে টেলিফোন দুনিয়ায়। আইফোন বাজারে আসার আগে বাজারের বেশিরভাগ ফোনই ছিল হয় কিপ্যাড নয়তোবা সিঙ্গেল টাচ। কিন্তু আইফোন ছিল সেই সময়কার লেটেস্ট কমপ্লিটলি মাল্টি টাচ স্মার্টফোন। আইফোনের দেখাদেখি গুগলও তাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোন বাজারে লঞ্চ করে।
এরপর টনক নড়ে নোকিয়ার। বাজারের দখল ধরে রাখতে তারা NS800 নামক প্রথম টাচ স্ক্রিন ফোন বাজারে আনে। সেই সময় NS800 ও যথেষ্ট পপুলার হয়। কিন্তু এই ফোনের সফটওয়্যার ছিল খুবই স্লো। অন্যদিকে যারা অ্যান্ড্রয়েড ফোন বা আইওএস ফোনের সফটওয়্যার ছিল ফাষ্ট। ইউজাররা নোকিয়া থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। স্লো সফটওয়ারকে ফাস্ট করতে নোকিয়া মিগো ওএস নামক নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম লঞ্চ করে। এরপর পুনরায় ধীরে ধীরে নিজের পুরনো কাস্টমারদেরকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় নোকিয়া। মিগো ওএস বাজারে খুবই জনপ্রিয় হয়।
সবকিছু ঠিকই চলছিল, এরপর মাইক্রোসফট কোম্পানির এমএসঅফিসের ইন্টার্নাল বিজনেস হেড স্টিফেন এলোপ নোকিয়া জয়েন করেন। মিগো ওএস যখন বাজারে রমরমিয়ে চলছে, তখন স্টিফেন ইলোপ তৎকালীন মাইক্রোসফটের সিইও স্টিভ বলমারের সঙ্গে মিলে মাইক্রোসফট এর অপারেটিং সিস্টেম নোকিয়া মোবাইল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেন।
এরপর মাইক্রোসফ ওএস দ্বারা নির্মিত নোকেয়ার লুমিয়া সিরিজ বাজারে আসে। কিন্তু প্রত্যাশমত যা ইউজারদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়। নোকিয়া লুমিয়ার মাইক্রোসফট ওয়েস কোনোভাবেই ইউজার ফ্রেন্ডলি ছিল না। মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেমটির মধ্যে ছিল একাধিক কমপ্লেক্স ইস্যু। ধীরে ধীরে ফের বাজার হারাতে থাকে নোকিয়া।
২০১৩ সালের সময়কালে ইউজারদের মন থেকে নোকিয়া কার্যত মুছে যেতে থাকে। সংস্থার লোভ্যাংশের পরিমাণ এক ধাক্কায় ২৪ শতাংশ ধাক্কা খায়। প্রতিবছর আনুমানিক ৪ বিলিয়ন ডলারের লসের মুখ দেখতে হয় নোকিয়াকে।
এরপর আসে সেই সময় যার পর, নোকিয়া এখনো পর্যন্ত নিজেদের হারানো জমি উদ্ধার করতে পারেনি। ২০১৩ সালের তেশরা সেপ্টেম্বর ৫০ বিলিয়ন ডলারের সংস্থা নোকিয়া কে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলারে মাইক্রোসফট অধিগ্রহণ করে নেয়। কিন্তু কোম্পানির দামে এই রেকর্ড পতনের কারণ কি ? এর পেছনে ছিল এক ভয়ঙ্কর নোংরা রাজনীতি।
বিজনেস অ্যানালিটিক্সদের একাংশের মতে শুরু থেকেই স্টিফেন এলোপের উদ্দেশ্য সাধু ছিল না। তিনি নোকিয়া জয়েন করার পর কখনোই লাভের মুখ দেখেনি সংস্থা। আসলে তিনি কখনোই সংস্থার গ্রোথ চাননি। আসলে নোকিয়াকে মাইক্রোসফটের কাছে বিক্রি করে নিজে সিইও এর চেয়ারে বসতে চেয়েছিলেন তিনি। এর পেছনের যুক্তি হিসেবে বিজনেস অনলেটিক্সদের একাংশ ২০১৪ সালে নিযুক্ত হওয়া মাইক্রোসফট এর সিইও সত্য নাদেলার একটি স্টেটমেন্টকে সামনে আনেন। ২০১৪ সালে মাইক্রোসফটের সিইও এর কুর্সিতে বসে সত্য না দিলে বলেছিলেন, নোকিয়া কে অধিগ্রহণ করা ছিল মাইক্রোসফটের অন্যতম বড় ভুল সিদ্ধান্ত। এরপর পুনরায় সত্য নাদেলা নোকিয়াকে পুনরায় hmd গ্লোবালকে বিক্রি করে দেন। এইভাবেই কার্যত টেলিফোন জগতে যবনিকা পতন ঘটে নোকিয়ার।
নোকিয়া কোম্পানির এই কেস স্টাডি থেকে কয়েকটি বিষয়ে আমরা শিখতে পারি, যা আমরা আমাদের নিজেদের ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রে মাথায় রাখবো।
প্রথমত, কমপ্লেক্সিটিজ ব্যবসা হোক বা মোবাইল ফোনের অপারেটিং সিস্টেম কমপ্লেক্স কোন বিষয়ই মানুষ পছন্দ করে না। এছাড়াও ডিসিশন মেকিং প্রসিডিওর যদি অতিরিক্ত টাইম টেকিং হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রেও তার মাশুল গুনতে হয় সংস্থাকে।
দ্বিতীয়ত, কোম্পানির কর্মী নিয়োগ করতে হবে অত্যন্ত বুঝে শুনে। শুধুমাত্র দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে কর্মী নিয়োগ করলেই হবে না। সেই ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও যথেষ্ট অবহিত হওয়া জরুরী। যার বৃহৎ উদাহরণ স্টিফেন ইলোপ. স্টিফেন ইলোপ এর উদ্দেশ্য আসলেই অসৎ ছিল কিনা তা বিতরকের বিষয়। তবে ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
তৃতীয়ত, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে আপগ্রেড করা। স্যামসাং, মোটরলা, এমআই, ওয়ান প্লাসের মতন একাধিক কোম্পানি সময় মত অ্যান্ড্রয়েডের ইকো সিস্টেমকে গ্রহণ করে আজ বাজারে একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে। অন্যদিকে অ্যাপল তার নিজের অপারেটিং সিস্টেমকে এতটাই পাওয়ারফুল করে তুলেছে যে, একবার যে-ব্যক্তি অ্যাপেল ইউজ করেছেন দ্বিতীয়বার তিনি অ্যাপেলের প্রোডাক্টটি ইউজ করতে চান। কিন্তু নোকিয়া না অ্যান্ড্রয়েড ইকো সিস্টেমকে এডপ্ট করতে পেরেছে, না তো নিজেদের শক্তিশালী ওএস ইকোসিস্টেম তৈরি করতে পেরেছে। এই হলো আমাদের আজকের প্রতিবেদন নোকিয়ার কেস স্টাডি।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ