Trending
শিল্পের যেমন মৃত্যু হয় না, শিল্পীরও তেমন মৃত্যু নেই। রক্তমাংসের শরীরটা এই পৃথিবীর বুকে না থাকলেও শিল্পীর সৃষ্টিই শিল্পীকে অমরত্ব দেয়। কেকে-র ক্ষেত্রে এই কথাটিই খাটে। দিনের পর দিন অমানুষিক পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় দিয়ে যিনি আধুনিক সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন। সেই কৃষ্ণকুমার কুন্নথ আজ আর নেই। কিন্তু তাঁর একের পর এক সৃষ্টি রয়ে গিয়েছে আমাদের মধ্যে। আসুন, আজ আমরা জেনে নিই কেকে বা কৃষ্ণকুমার কন্নথ সম্পর্কে কিছু কথা।
১৯৬৮ সালে দক্ষিণ ভারতীয় একটি পরিবারে জন্ম হয় কৃষ্ণকুমার কুন্নথের। জন্মশহর দিল্লি। সেখানেই পড়াশুনো। তারপর দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক হবার পর কয়েক মাসের জন্য কাজ করেছিলেন মার্কেটিং এগজিকিউটিভ হিসেবে। কিন্তু ভাগ্য বদলের সময় হল যখন ১৯৯৪ সালে তিনি পাকাপাকিভাবে চলে এলেন বাণিজ্যনগরী মুম্বইতে। প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষা না থাকলেও কেকে-র গলাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় তুরুপের তাস। ১৯৯৪ সালে জিঙ্গলে গান গাওয়ার মাধ্যমে তাঁর সঙ্গীত জগতে প্রবেশ। চার বছরের ব্যবধানে ১১টি ভাষায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জিঙ্গল গেয়েছেন কেকে। এরপর ১৯৯৭ সালে রিলিজ করা দক্ষিণী ছবি মিনসারা কানাভুতে এআররহমানের হাত ধরে সিনেমা জগতে প্রবেশ করেন কেকে। গানটি দক্ষিণী শ্রোতাদের মধ্যে ঝড় তুললেও সর্বভারতীয় তারকা হিসেবে তখনও তাঁর আত্মপ্রকাশ হয়নি। এরপর ১৯৯৯ সালে রিলিজ করল হাম দিল দে চুকে সনম। সেই সিনেমায় কেকে-র গলায় ‘তড়প তড়প কে ইস দিল সে’ গানটি সর্বভারতীয় দর্শক এবং শ্রোতাদের মধ্যে চরম জনপ্রিয়তা পেল। তারপরেই গুলজারের মাচিস সিনেমায় ‘ছোর আয়ে হাম’ গান। ব্যস। কেরিয়ারের উত্থান শুরু এখান থেকেই।
তারপর অবশ্য পিছন ফিরে তাকান নি কেকে। তাঁর রিলিজ করা দুটি অ্যালবাম ‘পল’ রিলিজ করে। এই অ্যালবামের টাইটেল ট্র্যাক সেইসময় তরুণ প্রজন্মের মধ্যে কার্যত হৈচৈ ফেলে দেয়। এই অ্যালবামের বেশ কয়েকটি গান এতগুলো বছর পেরিয়েও এখনো সমানভাবে জনপ্রিয়। সনি মিউজিক থেকে রিলিজ হওয়া এই অ্যালবামের জন্য কেকে স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীতশিল্পীর পুরস্কার জিতে নেন। তারপর অবশ্য একের পর এক বলিউড সিনেমায় প্লে ব্যাকের অফার পেতে থাকেন কেকে। ম্যায় হু না থেকে ওম শান্তি ওম, লাইফ ইন আ মেট্রো থেকে গ্যাংস্টার, বাচনা এ হাসিনো, কাইটস বা বজরঙ্গি ভাইজান- একের পর এক সিনেমায় তাঁর গান কার্যত ভারতীয় দর্শকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন তৈরি করে।
শুধু হিন্দি ভাষাতেই নয়। কেকে গান গেয়েছেন বাংলা, তামিল, তেলুগু, কন্নর, মালায়ালম, মারাঠি, ওড়িয়া, অহমিয়া এবং গুজরাতি ভাষাতে। শুধু সিনেমার জন্য কেকে-র গানের সংখ্যা ২০০-রও বেশি। সংযত জীবন যাপন। চরম পরিশ্রম এবং অধ্যবসায় সবমিলিয়েই কেকে হয়ে উঠেছিলেন এক সর্বভারতীয় শিল্পী। শোনা যায়, একবার নাকি তাঁর কাছে মোটা অঙ্কের পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অভিনয়ের প্রস্তাবও এসেছিল। কিন্তু কেকে শুধুই ভালোবাসতেন গান। তাই সঙ্গীত জগত থেকে তিনি নিজেকে বের করে আনতে চাননি। সর্বদা হাসিখুশি এই মানুষটিকে পছন্দ করতেন দেশের প্রথম সারির প্রযোজক থেকে পরিচালক থেকে সুরকার প্রত্যেকেই। আজ কেকে নেই। অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। কিন্তু এটাই যে বাস্তব। কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এসে পারফর্ম করার পরেই তিনি ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে। যে শিল্পীর জীবনে সঙ্গীত ছাড়া আর কিছুই ছিল না, যিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত একজন পারফর্মার, তাঁর মৃত্যুও হল সেই পারফর্ম করার পরেই। কেউ কি বুঝেছিলেন? মনে হয় না। তিনি হাসিমুখে পারফর্ম করেছেন তারপরেই মাত্র ৫৪ বছর বয়সে শেষ করেছেন তাঁর সঙ্গীতসফর। চিরকালের জন্য। তাঁর শূন্যতা কেউ পূরণ করতে পারবে না। আর প্রয়োজনও বোধ হয় নেই। কারণ গান ভালোবাসেন যারা তাঁদের কাছে কেকে রেখে গেলেন অনেক কিছু। ঐ যে শুরুতেই বললাম, শিল্পের যেমন মৃত্যু নেই, তেমনই মৃত্যু নেই শিল্পীরও।