Trending
আচমকাই পাখিদের মধ্যে একটা ছটফটে ভাব লক্ষ্য করা গেছিল। তাদের মধ্যে ধরা পড়ছিল একটা অস্থিরতা। কিন্তু কেন? আমরা প্রত্যেকেই জানি, বড়সড় কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপস্থিত হলে, সেক্ষেত্রে তার আভাস আগেই পেয়ে যায় পশুপাখিরা। এবারেও তার অন্যথা হল না। কারণ তার কিছু সময় পর ৬ ফেব্রুয়ারির ভোর ৪:১৭ মিনিটে কেঁপে উঠল তুরস্ক সহ সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। পাখির ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে নেটমাধ্যমে। আর তুরস্ক এবং সিরিয়ার জনজীবনে নেমে এলো চরম বিপদ। রিখটার স্কেলে ধরা পড়ল কম্পনের তীব্রতা- ৭.৮। প্রাণ চলে গেল ৪১ হাজারের বেশি মানুষের। আহত আরও কয়েক হাজার। লক্ষ লক্ষ মানুষের মাথায় আজ ছাদ নেই, পেটে খাবার নেই। ভবিষ্যৎ একেবারে অন্ধকার। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ভূমিকম্পের দাপটে জীবনের ক্ষতি যেমন হল, ঠিক তেমন ভাবেই এক ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ল দেশটা। তবে বিজ্ঞানীদের নাকি সতর্কবার্তা আগে থেকেই ছিল। যে-কোন দিন কেঁপে উঠতে পারে তুরস্ক- এই ছিল তাঁদের ফোরকাস্ট। সত্যিই কি তাই? এই সব নিয়েই আজ বিজনেস প্রাইম নিউজের পক্ষ থেকে রইল এক বিশেষ প্রতিবেদন।
তুরস্ক হচ্ছে জাপানের মতন বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্প প্রবণ দেশ। তার জন্য তুরস্কের ভৌগলিক অবস্থান অনেকটাই দায়ি। টেকটনিক প্লেটের কারণেই তুরস্কের মাটি মাঝেমধ্যে কেঁপে ওঠে। আসলে, তুরস্ক অবস্থিত আনাতোলিয়ান টেকটনিক প্লেটের ওপর। এছাড়াও রয়েছে আরও দুটো টেকটনিক প্লেট। একটি ইউরেশিয়ান এবং অন্যটি আফ্রিকান। আর এদের সঙ্গে আরও একটি প্লেট এসে যুক্ত হয়েছে যেটা হল আরাবিয়ান প্লেট। আমরা সকলেই জানি যে এই প্লেটগুলোর যদি কোন একটি সামান্য নড়াচড়া করে তাহলেই ভূমিকম্প হবার মত ঘটনা ঘটে থাকে। তুরস্কের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে। কারণ এই দেশের ফল্টলাইন বা যাকে আমরা টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল বলতে পারি, সেটা হল উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন। এই সংযোগস্থলেই এসে মিশেছে আনাতোলিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান টেকটোনিক প্লেট। ইস্তানবুলের একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত থেকে সটান তুরস্কের উত্তর সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত এই উত্তর আনাতোলিয়ান ফল্ট লাইন। অতীতেও যতবার তুরস্কে ভূমিকম্প হয়েছে সেটার পেছনে এই ফল্টলাইন অনেকটাই দায়ি বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ লন্ডনের একটি তথ্য বলছে, ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর মাসে এমন ভয়াবহ ভূমিকম্পের সাক্ষী ছিল তুরস্ক। সেবার দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭.৮। প্রায় ৩০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল সেবার। এছাড়াও ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে তুরস্কের ইস্টার্ন রিজিওনে আরও একটি ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সেই সময় ৪১ জন মানুষের প্রাণহানি হয়। ৬ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের ভূমিকম্প যেন সবকিছুকে ছাপিয়ে গেল। ৪১ হাজার মৃত্যুর সাক্ষী থাকল তুরস্ক। একইসঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের ভবিষ্যৎ ধূলিসাৎ হয়ে গেল এক নিমেষে। এই অবস্থায় দেশটার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ যে বড়সড় কিছু হবে, সেটা আলাদা করে বলার প্রয়োজন আশা করি নেই। কার্যত এই পরিস্থিতিতে যে দেশের আর্থিক উন্নতি অনেকটাই হোঁচট খেতে পারে, সেটাও আলাদা করে বলা অর্থহীন। কিন্তু ক্ষতির অঙ্ক কতটা হল, আর সেক্ষেত্রে কি তুরস্ক সরকার ফের ঘুরে দাঁড়াতে পারবে?
তুর্কি এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড বিজনেস কনফেডারেশনের একটি তথ্য বলছে, বিধ্বংসী ভূমিকম্পের সাক্ষী থাকতে হল তুরস্ককে। ক্ষতির অঙ্কটা ছাপিয়ে যেতে পারে প্রায় ৮৪ বিলিয়ন ডলার। তুরস্কের জিডিপির ১০%। মূলত এই দেশের হাউজিং কমপ্লেক্সগুলো সবথেকে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। ভূমিকম্পের কারণে শুধু হাউজিং কমপ্লেক্সগুলোর ক্ষতির অঙ্কটা দাঁড়িয়েছে ৭০.৮ বিলিয়ন ডলারে। এখানেই শেষ নয়, দেশটিতে বিপুল সংখ্যার শ্রমজীবী মানুষ রয়েছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার। অন্ধকার দেশটির শ্রমখাত। সেক্ষেত্রেও ক্ষতির অঙ্কটা পৌঁছে যেতে পারে প্রায় ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। এছাড়া রাস্তাঘাট, পাওয়ার গ্রিড, স্কুল এবং হাসপাতালের ক্ষতির অঙ্কটাও মারাত্মক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছে। তুরস্কের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫.৪% চলে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোগান ইতিমধ্যেই ভূমিকম্পের ত্রাণ হিসেবে বরাদ্দ করেছেন প্রায় ৫.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ইতিমধ্যেই ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বাদ নেই ভারত। চালু করেছে অপারেশন দোস্তি। এখানেই বলি ‘দোস্ত’ শব্দটা তুরস্ক এবং হিন্দি- দুই ভাষাতেই পাওয়া যায়। উদ্ধারকার্য চালানোর জন্য সেই দেশে পৌঁছে যায় ভারতীয় সেনার বিপর্যয় মোকাবিলা টিম। এক ভারতীয় সেনা অফিসারকে জড়িয়ে ধরে মাতৃস্নেহে তুরস্কের এক মহিলার চুম্বন করার দৃশ্যও গোটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। সেখানে অক্লান্তভাবে কাজ করছে মেডিক্যালের একটি টিম। বিপদের সময় তুরস্কের পাশে ভারত সরকারের এভাবে দাঁড়ানোটাই নতুন করে দোস্তির সমীকরণ রচনা করে দিল। তবে শুধু ভারত বলেই নয়। ফিফা নাকি তুরস্ককে সাহায্য করার জন্য ১০ লক্ষ ডলার অনুদান ঘোষণা করেছে। এছাড়াও লিওনেল মেসি ফাউণ্ডেশন তুরস্ককে ৩.৫ মিলিয়ন ইউরো অর্থসাহায্য করেছে। ক্রিশ্চিয়ানা রোনাল্ডো নিজের জার্সি নিলামে তুলেছেন। সেই অর্থ পুরোটাই দেওয়া হবে তুরস্কে ত্রানের জন্য।
তুরস্কে এখন মারাত্মক ঠাণ্ডা। শৈত্যপ্রবাহ চলছে। ভূমিকম্পে এতো বেশি মানুষের মৃত্যু কেন হল, এই নিয়ে অনেকেই বলেছেন, বিপর্যয় নামে ভোরবেলা। সেই সময় অধিকাংশ মানুষই ছিলেন ঘুমিয়ে। আর যে কারণে এতো এতো মানুষের প্রাণ গেল চলে। এতো বড় বিপর্যয় ঘটে গেলে, সেই দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ে। তুরস্কের জন্যও তার কোন ব্যতিক্রম হবে না। এখন শুধু অপেক্ষা। তাড়াতাড়ি নিজের স্রোতে ফিরে আসুক তুরস্ক। যারা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁদের আর ফিরে পাওয়া যাবে না। কিন্তু যারা এই বিপর্যয়ের সঙ্গে লড়াই করে এখনো টিকে রয়েছেন, ফিরে আসুন তাঁরা। অন্ধকার সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে আলো দেখুক তুরস্ক।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ