Trending
দফারফা বাংলার ইমেজের। সিঙ্গুর কাণ্ডে জয় তাহলে টাটার? ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়া বাংলার হাতে আর কোন অপশন নেই? দোষ কার? বর্তমান রাজ্য সরকারের? নাকি বাম সরকারের? তাহলে কি কর্মসংস্থানের প্রশ্নে বাংলা চিরকালই অভাগা থেকে যাবে? চলুন, এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা যাক আজকের প্রতিবেদনে।
সাল ২০০৬। বাংলায় কর্মসংস্থানের ভাগ্য সুনিশ্চিত করেছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রতন টাটাকে পাশে নিয়ে সিঙ্গুরে গাড়ি তৈরির কারখানার ঘোষণা করলেন তিনি। প্রায় ১ হাজার একর জমি দেবার প্রস্তাব পাশ করে বাম সরকার। পুরোটাই প্রায় কৃষিজমি। স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবার পথে সময় বেশি লাগল না। ২০০৭ সালে সিঙ্গুরে শুরু হল কারখানা নির্মাণ। কিন্তু হঠাৎ নির্মাণের স্বপ্ন থমকে গেল। বাধা দিলেন কৃষকদের একাংশ। তাদের আন্দোলনের কারণ, জমি অধিগ্রহণ বাম সরকার ঠিকঠাক ওয়েতে করেনি। ক্ষোভ বৃদ্ধি পেল কৃষকদের। আর সেই ক্ষোভকে হাতিয়ার করল তৃণমূল। বাংলায় সরকার বদলের পট পরিবর্তন এখান থেকেই। সিঙ্গুর আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। পরিস্থিতি যেদিকে এগোল, ২০০৮ সালে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে বৈঠক সারলেন টাটারা। এবং অবশেষে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হলেন তারা।
কথায় বলে, যে রাজ্যে টাটারা আসে সেই রাজ্যের শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হয়। ন্যানো গাড়ির কারখানা হলে কর্মসংস্থানে জোয়ার আসত। বাংলায় এমপ্লয়মেন্টের ভাগ্য আরও বদলে যেত যদি টাটার পথে হেঁটে আসত অন্যান্য কর্পোরেট সংস্থাগুলি। শুধু ন্যানো কারখানা তৈরি হলেই ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হত। এই কথাটা আমাদের নয়। খোদ রতন টাটার। তবে একটা ব্যপার। রতন টাটা স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তিনি সম্মান করেন। তিনি চেয়েছিলেন, সিঙ্গুরে টাটা গোষ্ঠী থাকুক। কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হোক। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আশ্বাস দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু বাম আমলের স্বপ্ন পূরণ হয় নি। এদিকে কারখানা হবার প্রস্তাব জলাঞ্জলিতে গেল। কৃষকদের আন্দোলনকে হাতিয়ার করলেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ৩৪ বছরের বাম সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করে মুখ্যমন্ত্রী হলেন তিনি। বললেন, কৃষিজমি ফিরিয়ে দেবেন সকল কৃষকদের। দেওয়া হবে ক্ষতিপূরণ। গণ্ডগোল শুরু এখান থেকেই।
তৃণমূল সরকার টাটাকে বিকল্প জমি দিয়ে কারখানা গড়ার প্রস্তাব দিল। কিন্তু টাটারা ততদিনে বাংলা ছেড়ে গুজরাতে। সানন্দে ন্যানো কারখানা তৈরি হয়ে গেছে। অগত্যা সরকারের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল টাটা। সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হল, বাম সরকারকে জমি অধিগ্রহণ বাবদ ১৫৪ কোটি টাকা তারা দিয়েছিল। সমপরিমাণ অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে টাটা দাবি করল। আইনি জটিলতা সময়ের সঙ্গে দীর্ঘ হতে লাগল। সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালে জানাল, সিঙ্গুরে বাম সরকার যেভাবে জমি অধিগ্রহণ করেছিল তা অবৈধ। টাটা মোটরস পাল্টা জবাব দিল। তাদের বক্তব্য হল, অন্য আরেকটি পলিটিকাল পার্টি ক্ষমতায় এসেছে বলে মামলার মাঝখানে অবস্থান পরিবর্তন অসম্ভব। আদালত পাল্টা যুক্তি দেয়। অধিগ্রহণ যখন বেআইনি, সরকার তখন অবস্থান বদল করতেই পারে। অগত্যা, জল আরও বেশিদূর গড়ানোর আগেই মধ্যস্থতাকারী প্যানেলের সহায়তা চায় টাটা। এবার সেই প্যানেল জানিয়ে দিল রাজ্য সরকারকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে ৭৬৬ কোটি টাকা। এই ক্ষতিপূরণ কে দেবে? ওয়েস্ট বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড। আচ্ছা, এটা কিন্তু সুদ ছাড়া। সঙ্গে বলা হয়েছে, যতক্ষণ না ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। আর মামলা বাবদ টাটা গোষ্ঠীকে দিতে হবে আরও ১ কোটি টাকা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলার অর্থনীতি কি টাটা গোষ্ঠীকে এই টাকা দিতে পারবে? রাজ্য সরকারের সামনে কি আর কোন উপায় নেই? ইতিমধ্যেই তৃণমূল শিবির থেকে সাফ বলা হয়েছে, এই বিশাল অঙ্কের যে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে তার জন্য একমাত্র দায় বর্তায় তৎকালীন বাম জমানার ওপর। তাদের অদূরদর্শিতা আজ বাংলাকে এভাবে প্যাঁচে ফেলেছে। কিন্তু সত্যি করে বলুন দেখি, তৃণমূল সরকারে আসার পর বাংলায় শিল্প মানচিত্র কি আদৌ উজ্জ্বল হয়েছে? চাকরিপ্রার্থীদের ধর্না, আন্দোলন সবই তো চলছে। শিল্প নেই। বেকারত্ব বাড়ছে। ২০২৩ এর মার্চের হিসেব বলছে, পশ্চিমবঙ্গে আনএমপ্লয়মেন্ট রেট থাকবে ৪.৮৪ শতাংশ। তাহলে কি বেকারত্বের এই সুরাহা নেই? যে কটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্টের কথা শোনা গেছে, সেটাই বা কবে হবে? এই যেমন তাজপুর বন্দর, ডেউচা-পাচামি খনি…আর সবথেকে বড় কথা- বাংলায় বড় বড় কর্পোরেট সংস্থারা আসছে না কেন? বাংলায় ট্যালেন্ট নেই, এই কথা একবুক গঙ্গা জলে দাঁড়িয়ে কেউ বললেও বিশ্বাস করবে না। মেধায় তারা টক্কর দেবে দেশের যে কোন রাজ্যের মেধাবীদের। তারা আজ ডিগ্রি নিয়ে হয় রাজ্য ছাড়ছে, না-হয় দেশ ছাড়ছে। আর এসব দেখে একটাই বিষয় মাথায় আসে। বর্তমান শাসক শিবির তাহলে কাজ তৈরির জন্য ভালোরকম এনভায়রনমেন্ট তৈরি করতে পারে নি। কর্পোরেট সংস্থাগুলোকে ফিউচার অ্যাস্পেক্ট দেখাতে পারেনি বাংলা।
সেকশন ৩৪ অফ আরবিট্রেশন অ্যান্ড কনসিলিয়েশন অ্যাক্ট অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের নির্দেশকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে রাজ্য সরকার। সেই রাস্তা খোলা রয়েছে তাদের। কিন্তু এসব করে কি বাংলার ইমেজ আদৌ ফিরে আসবে? নাকি শিল্পহীন রাজ্যের তকমা নিয়েই ঘুরতে হবে বাংলাকে? আর যদি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আবার মুখ পোড়ে, মানে শাসক শিবির যদি হেরে যায় তাহলে তো গোদের ওপর বিষফোঁড়া। রাজনৈতিক তরজা চলছে, আইনি প্রক্রিয়া চলছে। সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎ এখন একবুক পাঁকে দাঁড়িয়ে। আর গতকালের রায় তো বলেই দিল, শিল্পহীন বাংলা কিভাবে নাস্তানাবুদ হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। ভুল বাম করুক, রাম করুক অথবা ডান। দিনের শেষে শিল্প না এলে আদতে ক্ষতি রাজ্যের। রাজ্যের ক্ষতি মানে সেটা দেশের অর্থনীতির ক্ষতি। সিঙ্গুরের ক্ষত চিরকাল বাংলার বুকে থেকে যাবে। সঙ্গে এই প্রশ্নটাও থেকে যাবে যে, সিঙ্গুর আন্দোলন না-হলে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে পারতেন না তেমনই বাংলায় শিল্পের চেহারাটাও সার্বিকভাবে ধাক্কা খেত না। টাটার বিদায় বড় ভুল। সেই ভুল যেই করুন না কেন, এতগুলো বছর পরেও সেই ভুলের মাশুল এখনো গুনতে হচ্ছে বাংলার তরুণ প্রজন্মকে। টাটাদের কাছে কি তাহলে সত্যি হেরে গেল বাংলা? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক করুন, শেয়ার করুন। আর নতুন হলে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের চ্যানেল বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ