Story
সুন্দরবন। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য। রহস্য এবং জীববৈচিত্র্যের এক সুন্দর সহাবস্থান। জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ,পাড়ে বাসিন্দা। মৃত্যুভয় যেখানে প্রতিটা মুহূর্তে অপেক্ষা করে বসে থাকে। কেউ ধরতে যান মাছ, কেউ বা জলে নেমে খোঁজেন কাঁকড়া। আর কেউ প্রাণ হাতে করে চলেন মধু সংগ্রহের জন্য, গভীর জঙ্গলে। যেখানে উপার্জনের জন্য, বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে প্রতিদিন জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেতে হয়। কিন্তু আজ আমরা চলেছি সুন্দরবনের এমনই এক জায়গায় যেখানে উপার্জনের পথ নিশ্চিত। সঙ্গে প্রাণ হারানোর ভয়ও অনেকটা কম। আমরা জানি, বছরের পর বছর ধরে মধু সংগ্রহ করে দুবেলা দুমুঠো খাবারের টাকা উপার্জন করছেন সুন্দরবনের মধুজীবীরা। যেখানে আয়ের পথটিকে নিশ্চিত করতে গিয়ে তাঁদের নিজেদেরকেই অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিতে হয় বারবার। কিন্তু বিজ্ঞানের দৌলতে সঠিক গাইডলাইন মেনে চললে মধু সংগ্রহ বর্তমানে আর খুব একটা বিপজ্জনক নয়। আজ আমরা এসেছি কুলতলি রেঞ্জে। যেখানে গভীর জঙ্গলের মধ্যেই বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তৈরি হচ্ছে মধু। যে মধু সুন্দরবন থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন রাজ্যে বন দপ্তরের সহযোগিতায়। আর এই কর্মকাণ্ডের আসল উদ্যোক্তা সুন্দরবনের প্রলয় সামন্ত। জঙ্গলের অদূরেই একটি গ্রাম- ভুবনেশ্বরীতে যার বেড়ে ওঠা। বর্তমানে বনফুল ব্র্যান্ডের মধু বিক্রির দায়িত্ব তাঁরই কাঁধে। পাশাপাশি তিনি ভুবনেশ্বরীর জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির প্রেসিডেন্ট যার প্রধান কাজ গাছ এবং মানুষ দুয়েরই প্রাণ বাঁচানো। তার সঙ্গে অরণ্য নির্ভর মানুষদের একসঙ্গে নিয়ে এসে নিশ্চিত আয়ের সমাধান করে দেওয়া। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে মধু সংগ্রহের এই প্রচলিত রীতি থেকে ক’জনই বা বেরিয়ে এসে প্রলয়ের পাশে দাঁড়াচ্ছেন? তবে এই কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার জন্য তাঁর এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে অনেকে। কো-অপারেটিভ ব্যাঙ্ক থেকে শুরু করে বন দপ্তরের ভূমিকাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। যাদের ছাড়া বনফুলের পথ চলা প্রায় অসম্ভব ছিল। কিন্তু শুধু লোন দিলেই তো হল না। বিজ্ঞানসম্মতভাবে মৌমাছি চাষ করে মধু সংগ্রহ করার জন্য সঠিক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে। আর ঠিক সেই সময়ই এগিয়ে আসে রামকৃষ্ণ মিশনের নিমপিঠ আশ্রম। প্রলয় দাবি করছেন, তাঁদের তৈরি মধু একেবারেই নির্ভেজাল। তাই প্রকৃতির খেয়ালের ওপর নির্ভর করতেই হয়। কোনবার উৎপাদন হয় বেশি তো কোনবার কম। তবু এই মধু তৈরি করতে ন্যুনতম কোন রাসায়নিক বা কৃত্রিমতার প্রয়োজন পড়ে না। কিভাবে তৈরি হয় এই মধু? সেটাও জানালেন প্রলয়বাবু। আর মধু খাঁটি বলেই চাহিদাও বেশ ভালোই। অ্যামাজন থেকে বিশ্ব বাংলা সব জায়গাতেই বনফুলের মধুর চাহিদা রয়েছে। আর শুধু রাজ্যেই বা কেন? রাজ্যের বাইরে বিহার, গুজরাত, ব্যাঙ্গালোর, ওড়িশা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ প্রত্যেকটি রাজ্য থেকে বনফুলের মধু অর্ডার দেওয়া হয়। কিন্তু এখন আর তাঁরা শুধু সুন্দরবনেই আটকে থাকতে চান না। বনফুল ছড়িয়ে পড়তে চায় সমতল থেকে একেবারে পার্বত্য অঞ্চলেও। শুধু মধুতেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাইছেন না প্রলয়বাবু। তিনি চাইছেন বনফুল শুধু মধুর মধ্যেই আটকে থাকবে না। ছড়িয়ে পড়বে আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এতে স্বনির্ভর হবেন সুন্দরবনের মহিলারাও। সুন্দরবনের মধু তৈরির যে আসল কারিগর সেই দেশি মাছিটাই একরকম উধাও হয়ে গেছে আম্ফান ঝড়ের পর। এখন প্রলয়ের ভরসা তাই ইতালিয়ান মৌ ইতালিয়ান মেরিফেরা। সেই মৌমাছি উত্তর ২৪ পরগনা থেকে কিনে আজ বনফুল এগিয়ে চলেছে তার নিজস্ব লক্ষ্যে। দামে হয়ত একটু বেশি, কিন্তু মানেও খাঁটি। তাই ঘরে ঘরে পৌঁছে যাক বনফুল ব্র্যান্ডের মধু। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন সরকারি সাহায্যের। সরকার তাকালে নিঃসন্দেহে বনফুল ছড়িয়ে পড়বে বাংলা থেকে বিশ্বে। এই আশা বুকে নিয়েই একের পর এক মাইলস্টোন পেরনোর স্বপ্ন দেখছেন প্রলয়ের মত বনফুলের সঙ্গে যুক্ত সকলেই। দেবলীনা ভট্টাচার্য সুন্দরবন