Trending
রাশিয়া। ইউক্রেনের সঙ্গে লাগাতার যুদ্ধ চালিয়ে যাবার কারণে পশ্চিমা দেশ সহ মার্কিন মুলুকের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে এই দেশ। পৃথিবীর সামগ্রিক ভূ-খণ্ডের ১১% রাশিয়ার। বর্তমানে রাশিয়ায় আয়তনের দিক থেকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ দেশ। রাশিয়ার মোট জিডিপি ১.৭৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যা এই দেশকে গ্লোবাল র্যাঙ্কিং-এ রেখেছে ১১ নম্বরে। খনিজ সম্পদে ভরপুর এই দেশটি যে বিশাল পরিমাণ এক্সপোর্ট করে থাকে, তার বিচারেই রাশিয়ার অর্থনীতি দিন দিন মজবুত হয়েছে। কিন্তু যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া মুখের কথা নয়। প্রতিদিন মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও রাশিয়া কিভাবে নিজের অর্থনীতিকে এতটা শক্তিশালী রাখতে পারল? আজ এই নিয়েই শুরু করা যাক আমাদের প্রতিবেদন- যুদ্ধ চালিয়েও রাশিয়া অর্থনীতি কিভাবে শক্তিশালী হচ্ছে?
রাশিয়ার অর্থনীতির যে মূল স্তম্ভগুলো রয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ফসিল ফুয়েল এবং অফুরান ন্যাচারাল রিসোর্সের খনি বলা যেতে পারে। তার মধ্যে রয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, কপার, গোল্ড, সিলিকনের মত মেটাল। তেমনই রয়েছে প্রচুর পরিমাণ মিনারেল এবং নন-মেটাল। আমরা সকলেই জানি, গোটা ইউরোপের সার্বিক ফসিল ফুয়েলের জোগান কে দিয়ে থাকে। সার্বিক জোগানের ৪০% দিয়ে থাকে রাশিয়া। সাল ২০২১। তারপর পটভূমি বদলাতে শুরু করে ২০২২ সাল থেকে। যখন ইউক্রেনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়ে দেশটি। সেই সময় ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সহ আমেরিকাও রাশিয়ার সঙ্গে ব্যবসায়িক সকল সম্পর্ক ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা নেয়। এমনকি সোনা এবং ফরেন রিজার্ভের ওপরে পড়ে নিষেধাজ্ঞা। দেখা যায়, ২০২২ সালে যেখানে এই নিষিদ্ধ ঘোষণার আগে ১ ডলারের নিরিখে রুবেল ছিল ৭৮ মতন, সেটাই পৌঁছে যায় প্রায় ১৩৮ রুবেলে। স্বাভাবিকভাবেই, সেই দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা একটা বড়সড় ধাক্কা তো বটেই। কিন্তু সব বাধা পেরিয়েও রুবেল নিজেকে শক্তিশালী করেছে। বর্তমানে ৭৬ রুবেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে ১ ডলারের মূল্য। আমরা সকলেই জানি, ডলারের বিপরীতে কোন দেশের মুদ্রার ভ্যালু বাড়া মানে, সেই দেশের অর্থনীতি অনেকটাই শক্তিশালী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাশিয়া অ্যালায়েড ফরসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জার্মান সেনাদের চিরতরে আটকে দিতে পেরেছিল ঠিকই, কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে একটা আতঙ্ক ছিল। রাশিয়ার কমিউনিস্ট সরকার হয়ত এই সকল দেশের প্রভাব ছড়াতে পারে। সেখান থেকেই তৈরি হয় কোল্ড ওয়ার। তারপর থেকেই রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে তৈরি হয় এক তীব্র প্রতিদ্বন্দিতা। সেটা নিউক্লিয়ার ক্ষমতা হতে পারে, আবার সেটা মহাকাশ গবেষণাও হতে পারে। কিন্তু রাশিয়া সত্তরের দশক থেকেই নিজের ইকোনমিক কন্ডিশনের ওপর জোর দিতে শুরু করে। কিন্তু আর্থিক বৈষম্য ছিল ভালোরকম। আর সেটাই রাশিয়ার অর্থনীতিকে একটু সংকটে ফেলে দিয়েছিল। কারণ বিত্তবানরা আরও বড়লোক হচ্ছিল, আর রাশিয়ার সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ গরীব থেকে গরীবতর হচ্ছিল।
এরপর কাট টু ১৯৮৫। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মাথা মিখাইল গরবাচেভ হাইব্রিড কমিউনিস্ট ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থায় বেশি নজর দেয়। কিন্তু তারপরেও রাশিয়ার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রাজনৈতিক পটভূমিকার জন্য বেশ বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। অবশেষে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। আর ওয়ার্ল্ড ম্যাপে রাশিয়া আলাদা দেশ হিসেবে উঠে আসে। ১৯৯২ সাল থেকে গোটা রাশিয়া জুড়ে শুরু হয় প্রাইভেটাইসজেশনের হাওয়া। দেখতে দেখতে ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার সার্বিক ইন্ডাস্ট্রির ৭০% জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে পরিণত হয়। এবং রাশিয়ার বাজারে মিশ্র অর্থনীতির প্রকাশ ঘটতে থাকে ভালোরকম। ২০২১ সালে রাশিয়ার পার ক্যাপিটা ইনকাম ছিল ১১ হাজার ৬০০ ডলার। আর পার ক্যাপিটা জিডিপি ছিল ১৪ হাজার ৬৭০ ডলার। রাশিয়ার অর্থনীতি শক্তিশালী হবার পিছনে কাজ করেছে দুটি কারণ। এক রাশিয়ার প্রচুর পরিমাণ ন্যাচারাল রিসোর্স। প্রায় গোটা ইউরোপেই রাশিয়া তাদের জ্বালানী বিক্রি করে নিজের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করছে। রাশিয়া ফসিল ফুয়েল, ন্যাচারাল রিসোর্স ছাড়াও কৃষিকাজে উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখেছে। গম, আলু, সিরিল জাতীয় বিভিন্ন শস্য উৎপাদন করে রাশিয়ার নিজের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি মজবুত করেই চলেছে। ২০২১ সালে রাশিয়া বিশ্বে ফসল রফতানি করে আয় করেছিল ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি। তবে রাশিয়ার অর্থনীতির উন্নয়নে আরেকটা বড় কারণ সেখানকার জনসংখ্যা। বিশ্বের সবথেকে বড় দেশ, অথচ জনসংখ্যা মাত্র ১৫ কোটি মতন। ফলে এই দেশে আভ্যন্তরীন খরচ যত না হয়, তার চেয়েও বেশি এক্সপোর্ট করার সুযোগ পায় রাশিয়া। এছাড়া ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রিতেও রাশিয়া উল্লেখযোগ্য ছাপ রেখছে। অটোমোটিভ থেকে শুরু করে রকেট ম্যানুফ্যাকচারিং- এই সবই আজ রাশিয়া নিজের দেশেই তৈরি করছে মেজাজে। যে কারণে রাশিয়া তার নিজের দেশের ইন্ডাস্ট্রির সকল চাহিদা পূরণ করছে আভ্যন্তরীণ ম্যানুফ্যাকচারিং-এর মাধ্যমে। ইমপোর্ট করার থেকে অনেক বেশি অঙ্ক এক্সপোর্ট করার জন্য রাশিয়ার কোষাগারে বড় অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা জমা হয়। ২০২১ সালের হিসেব বলছে, রাশিয়া আমদানি বাবদ যেখানে ৩৭৯.৯ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছিল, সেখানে রফতানি বাবদ আয় করেছে ৫৫০ বিলিয়ন ডলার। বর্তমানে রাশিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ রয়েছে ৫৮২ বিলিয়ন ডলার মতন।
সোভিয়েত সরকারের পতনের পর রাশিয়া গ্যাস এবং জ্বালানী মারফৎ নিজের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পেরেছিল। বিশ্বের ৩২% ন্যাচারাল গ্যাস রয়েছে রাশিয়ায়। রাশিয়ার অন্যতম বৃহৎ সংস্থা গ্যাজপ্রম একাই বিশ্বের চার ভাগের এক ভাগ গ্যাস রিজার্ভ করে রাখে নিজের কাছে। এছাড়া রাশিয়ার ৯০% গ্যাস আসে এই গ্যাজপ্রম মারফৎ। জানা গিয়েছে, ২০২১ সালে ইউরোপের ৪০% গ্যাস সরবরাহ করেছে রাশিয়া একাই। আর এলএনজি এক্সপোর্ট করে রাশিয়া ২০২১ সালে আয় করেছে সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আর ৫৪.২ বিলিয়ন ডলার এসেছে পাইপলাইন গ্যাস থেকে। এছারাও ২০২১ সালে রাশিয়া ১১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্রুড অয়েল এবং ৬৮ বিলিয়নের বেশি অয়েল প্রোডাক্ট রফতানি করেছে রাশিয়া। অর্থাৎ একটা বিষয় পরিষ্কার যে রাশিয়া নিজের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে এভাবেই। কিন্তু তারপর যখন ইউরোপ এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা জারি হল তখন? আসলে সেই সময় রাশিয়ার অয়েল ইন্ডাস্ট্রি কিছুটা হলেও ছাড় পায়। যে কারণে রাশিয়ার অর্থনীতি প্রাথমিকভাবে একটু হোঁচট খেলেও ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়। এছাড়া কয়লা উৎপাদন এবং রফতানিতেও রাশিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, কপার, প্যালাডিয়াম, সিলিকন এবং নিকেলের সম্ভার রয়েছে রাশিয়ায়। সিলিকন প্রোডাকশনে রাশিয়া রয়েছে দ্বিতীয়তে। অ্যালুমিনিয়াম প্রোডাকশনে রাশিয়া রয়েছে তৃতীয়তে। এছাড়া কপারের বিশ্বব্যাপী চাহিদার ২৫% পূরণ করে রাশিয়া। আর এগুলো ছাড়াও রাশিয়ার কাছে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে সোনা এবং হিরের ভাণ্ডার। আমেরিকাই ২০২১ সালে রাশিয়া থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি সোনা আমদানি করেছিল। এছাড়াও অ্যামোনিয়া, ফসফেট, ইউরিয়া প্রোডাকশনে রাশিয়া গ্লোবাল মার্কেটে কার্যত থাবা বসিয়েছে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন যে রাশিয়া নিজে কত সমৃদ্ধশালী একটি দেশ। আর সবথেকে বড় বিষয় হল, যে সকল দেশ রাশিয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইবে, তারাই ভবিষ্যতে যে ভালোরকম প্যাঁচে পড়তে পারে সেটা রাশিয়া নিজেও জানে। আরও বেশি করে এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো। তাই রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করা মানে, সেটা রাশিয়ার ক্ষতি নয়। বরং অন্য দেশের অর্থনীতির জন্য সেটা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর সেই জায়গা থেকেই রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দেওয়াটা হয়েও হয় না। সুতরাং যত যাই হয়ে যাক, রাশিয়ার অর্থনীতিতে গোঁত্তা খাবার সুযোগ তেমন একটা নেই। তাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পরেও এখনো শক্তিশালী রয়েছে রাশিয়ার অর্থনীতি।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ