Trending
ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা, কিভাবে?
চিনা ঋণের ফাঁদে কি আর দেয় নি পা, কেন?
দুঃসময়ের বন্ধু কোন কোন দেশ?
আর কিভাবে এই কঠিন চ্যালেঞ্জ অ্যাকসেপ্ট করল শ্রীলঙ্কা?
শ্রীলঙ্কা- ছোট্ট একটা দেশ কিন্তু জিও পলিটিক্যাল সেক্টরে যার ভ্যালু অনেক। আর শ্রীলঙ্কার ইকোনমিকে হাঙরের মতো ধীরে ধীরে গিলে নেবার তালে ছিল আড়ে বহরে অনেক বড় এশিয়ান জায়ান্ট চিন। একের পর এক প্রোজেক্টে চিন টাকা ঢেলেছে। প্রোজেক্ট কমপ্লিট, এবার টাকা দিতে না পারলে পুরোটাই নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে চিনের মাস্টারপ্ল্যান। তার মধ্যে অন্যতম হাম্বানটোটা বিমানবন্দর। শ্রীলঙ্কার ইকোনমি যে টাইটানিকের মতো ডুবছিল সেটা চিন আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল। কারণ শ্রীলঙ্কায় চিনের বিনিয়োগ ছিল বড় রকম। তবে শুধু চিনকেই কি দায়ী করা যায়? সাধারণ মানুষের মধ্যে সরকারের প্রতি তীব্র অনাস্থাও তো তৈরি হয়েছিল। মনে পড়ছে ছবিগুলো? বিক্ষোভ, মিছিল, প্রতিবাদ- গোটা দেশের মানুষ এমনভাবে খেপে উঠেছিলেন যে অনেকেই ধারণা করে নেয় শ্রীলঙ্কা একেবারে অন দ্য ভারজ অফ ইকোনমিক ফেলিওর।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৭০.৬ শতাংশে। দেশবাসীর হাতে টাকা নেই এদিকে আকাশছোঁয়া সব পণ্যের দাম। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের আকাল, সন্তানদের বড় করার জন্য মায়েদের হাহাকার শ্রীলঙ্কা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছিল একেবারে অন্ধকারে। বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নেমে আসে একেবারে তলানিতে। রফতানি প্রায় শূন্যে নেমে আসে, এদিকে আমদানি করার মতো সরকারের হাতে ছিল না টাকা। জনগণের চাপে কুর্সি ছাড়তে হয় প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষকে। ঝাপ পড়ে যায় ট্যুরিজম সেক্টরে। এগ্রিকালচার সেক্টরে নেমে আসে গভীর ক্ষত। সব মিলিয়ে শ্রীলঙ্কার দুর্দশা প্রকট হয়েছিল পুরো পৃথিবীতে। শ্রীলঙ্কার ভালো বন্ধু চিন তখন একবারের জন্য আর সাহায্য করার দিকে ঝোঁকে নি। হয়ত তারা ভেবেছিল, এমনিই দেশটায় তারা প্রচুর বিনিয়োগ করে বসে রয়েছে। এখন নতুন করে এড করার মধ্যে কোন যুক্তি খুঁজে পায় নি। কিন্তু সেই সময় শ্রীলঙ্কার এড এবং ট্রেড দুটোর প্রয়োজন ছিল ভালোরকম। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন ছিল ইকোনমিক রিফর্মসের। সুখের সময় পাওয়া যায় অনেককে। কিন্তু বিপদের সময় যারা পাশে থাকে তারাই হয় প্রকৃত বন্ধু। চোখ খুলল শ্রীলঙ্কার। এই দুর্দিনে পাশে দাঁড়াবে কে? এগিয়ে এলো আরেক এশিয়ান জায়ান্ট আমাদের ভারত। এছাড়া এগিয়ে এলো জাপান, বাংলাদেশের মতো দেশ। সঙ্গে পাওয়া গেল আইএমএফের আস্থা। অর্থাৎ সুযোগ যখন পাওয়া গিয়েছে, তখন ঘুরে দাঁড়ানোর আপ্রান চেষ্টা করতে শুরু করল শ্রীলঙ্কা। ফল মিলল হাতেনাতে। আচ্ছা, আরেকটা বিষয়। শ্রীলঙ্কার মতো ছোট্ট দেশের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৯৭ বিলিয়ন ডলারে। দেশটা ঋণ নেয় জাপান, ভারত, আইএমএফ এবং এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের কাছ থেকে।
পড়শি দেশ দুর্দিনে আর ভারত মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকতে পারে? তাই সবার প্রথমে এগিয়ে এলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর। আলোচনা করলেন প্রেসিডেন্ট বিক্রমাসিংঘের সঙ্গে। ভারত বলল, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে জ্বালানি পর্যটন এবং পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা আগ্রহী। তারপরেই আইএমএফের দফতরে চিঠি গেল ভারত সরকারের তরফ থেকে। নয়া দিল্লির সর্বপ্রথম এগিয়ে আসাটা দেখে শ্রীলঙ্কার তরফ থেকে ধেয়ে এলো প্রশংসার বন্যা। অন্যদিকে আইএমএফ নিশ্চিন্ত হল অনেকটা। কারণ অ্যাশিওরেন্স দিয়েছে খোদ ভারত সরকার। এছাড়া বাংলাদেশ নিজেও সেই সময় শ্রীলঙ্কার এই আর্থিক দূরবস্থা কাটাতে সাহায্য করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাফ জানিয়ে দেন কৃষি, মৎস্য, ওষুধ, সামুদ্রিক যোগাযোগ এবং উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। শ্রীলঙ্কায় তখন ওষুধ আর পণ্যের আকাল। ভারত জাহাজ ভর্তি করে পাঠাল পণ্য, বাংলাদেশ পাঠাল ওষুধ। যাই হোক, এভাবেই ধীরে ধীরে পড়শি দেশগুলোর সাহায্য নিয়ে যে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল শ্রীলঙ্কা, সেটাতে আজ অনেকটা সাকসেস পেয়েছে। কিরকম?
জুলাই মাসে দেখা যাচ্ছে শ্রীলঙ্কায় ট্যুরিজম খাতে বড়সড় পরিবর্তন এসেছে। ডেইলি মিরর এবং কলম্বো পেজের একটা প্রতিবেদন বলছে, জুলাই মাসে সবথেকে বেশি ট্যুরিস্ট ভ্রমণ করেছেন শ্রীলঙ্কায়। শ্রীলঙ্কা ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট অথোরিটি বলেছে, জুলাই মাসে দেশে পর্যটক এসেছে ১ লাখ ৪৩ হাজারের বেশি। গত বছরের থেকে ২০২% বেশি। এখানেও রয়েছে ভারতের অবদান। কারণ সবথেকে বেশি পর্যটক গিয়েছে ভারত থেকেই। ফলে ধীরে ধীরে শক্তিশালী হচ্ছে দেশটার ফরেক্স রিজার্ভ। এখানেই একটা বিষয় জানিয়ে রাখি যে, শ্রীলঙ্কা সরকার মাল্টিপল ট্যুরিস্ট এন্ট্রি ভিসার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে ৫ বছর পর্যন্ত। ৩৫টা দেশের জন্য সেটা প্রযোজ্য হবে। যার মাধ্যমে প্রায় ৬ মাস শ্রীলঙ্কাত থাকতে পারবেন তাঁরা। ফলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পিছনে ভালোরকম কাজ করছে ট্যুরিজম সেক্টর।
এছাড়াও দেখা গেল, সরকার একেবারে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছে। ফলে রাজস্ব বাড়িয়েছে দেশটা। সংস্কার আরও জোরালো ভাবে হচ্ছে। এগ্রিকালচারাল সেক্টরে শ্রীলঙ্কার কামব্যাক অভূতপূর্ব। রফতানি বেড়েছে মূলত চা এবং রবারের। শ্রীলঙ্কা থেকে অনেক শ্রমিক এবং আধা শ্রমিক বিদেশ গিয়েছেন। রোজগার ক্রমে বাড়ছে তাই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কে জমা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। একই সঙ্গে শ্রীলঙ্কার সরকার নজর দিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তার দিকে। কমিয়ে আনা হয়েছে রাষ্ট্রীয় ব্যয়। কমিয়ে আনা হয়েছে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সংখ্যা। আবার খুব তাড়াতাড়ি শ্রীলঙ্কা ভিজিট করবেন আইএমএফের সদস্যরা। সব ঠিক থাকলে আরও কিছু সাহায্য তারা করবে।
তবে এখনো শ্রীলঙ্কার সংকট কাটে নি। বেকারত্ব ভালোরকম রয়েছে, জীবন যাত্রার ব্যয় স্বাভাবিকের থেকে অনেকটাই বেশি, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানি করতে গিয়ে হোঁচট খেতে হচ্ছে দেশটাকে। কিন্তু যেভাবে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে শ্রীলঙ্কা তারপর আশা করাই যায় যে, খুব তাড়াতাড়ি এই দুর্দিন কাটিয়ে উঠতে পারবে তারা। আর যাই হোক, দিনের শেষে শ্রীলঙ্কা তো পাকিস্তান নয়।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ