Daily
মধ্যিখানে মসৃণ চওড়া রাস্তা। রাস্তার দু’দিকে গভীর শাল-পিয়ালের বন। যেখানে নেকড়ে, হায়না, হেরোল, শিয়ালের মতন বন্য জন্তুদের উৎপাত তো রয়েছেই। একইসঙ্গে পদে পদে রয়েছে বিষধর সাপের ভয়। কিন্তু পেট কারুর কথা শোনে না। তাই দু’বেলা, দু’মুঠো খাবারের জন্য এই সকল বিপদের তোয়াক্কা করেন না তাঁরা। বরং রোদ, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে প্রতিদিন জঙ্গলে প্রবেশ করতে হয় তাঁদের। সংগ্রহ করতে হয় শাল পাতা। কিন্তু এই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেই বা কি খুব একটা ভালো রোজগার তাঁরা করছেন? প্রশ্নের উত্তর তাঁদের কাছে নেই। দিন আনা দিন খাওয়ার সংসারে যতটুকু জোটে, সেটাই বা কম কি?
পশ্চিম বর্ধমান জেলার কাঁকসা জঙ্গলমহলের আদিবাসী সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের মহিলারা প্রাণের বাজি রেখেই লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে তৈরি করে চলেছেন শালপাতার থালা। একদিকে সচল রাখছেন পূর্ব পুরুষের জীবিকা। অন্যদিকে সংসার টানার জন্য এই জীবিকার উপরে নির্ভরশীলতা। বন্য জীবজন্তুদের আক্রমণের ভয়কে উপেক্ষা করে তাঁরা সংগ্রহ করছেন শাল পাতা।
শাল পাতা সেলাই করার জন্য রোদ-জল মাথায় নিয়ে বিভিন্ন এলাকার মাঠে ঘাটে গিয়ে সংগ্রহ করছেন কুচি কাঠি। এরপর সেগুলি বাড়িতে নিয়ে এসে একটি একটি করে পাতা সেলাই করে, তারপর শালপাতা যুক্ত করে তৈরী করতে হচ্ছে শালপাতার থালা। থালার মান বৃদ্ধির জন্য আবার ১০০০ টি থালাকে ডবল করে মোট ৪০০-৫০০ টি থালা তাঁরা তৈরি করছেন।
এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলারা জানাচ্ছেন, এত খাটুনির বিনিময়ে ওই ৪০০ পাতা বিক্রি করে তাঁদের মেলে মাত্র ৮০ টাকা। তাও আগে আগে মহাজনরা বাড়ি বাড়ি শালপাতার থালা সংগ্রহ করতে আসতেন। ৪০০ থালা পিছু দিতেন ১০০ টাকা করে। কিন্তু হঠাৎ করেই কয়েক মাস আগে কমিয়ে দেওয়া হয় পাতার দাম। কিন্তু এটা তো ঠিক যে শহরতলি থেকে গ্রামেগঞ্জে শালপাতা দিয়ে তৈরি থালার ব্যপক চাহিদা রয়েছে। চড়া দামে বিক্রিও হচ্ছে। কিন্তু লাভের গুড় খেয়ে যাচ্ছে কারা? আদিবাসী সম্প্রদায়ের হাড়ভাঙা পরিশ্রমী মানুষগুলোর হাতে টাকা আসছে কোথায়?
বনদফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্ধমান ডিভিশনে প্রায় ১৪ হাজার হেক্টর বনভূমি রয়েছে। এই বনভূমির অধিকাংশটাই শাল গাছের গভীর জঙ্গল। যেখানে হায়না, শেয়াল, বিষধর সাপ বা নেকড়ে বাঘের মত হিংস্র জীবজন্তুদের ছবি ধরা পড়েছে বন দফতরের ক্যামেরায়। আর এই জঙ্গলের আশেপাশেই বসবাস করছে বহু আদিবাসী সম্প্রদায়। যাদের অধিকাংশই শাল পাতার থালা তৈরি করে সংসারের চাকা ঘুরিয়ে চলেছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না ন্যায্য মূল্য। তাঁদের এই অভাব যেন জঙ্গলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। কে শুনবে তাঁদের কথা? ওরা নিজেরাও জানেন না। যেকটি টাকা হাতে কোনরকমে আসছে, তাই দিয়েই আপাতত দিন বদলের গল্প লিখে চলেছেন এই আদিবাসী মানুষগুলো।