Story
হলুদ রঙের পাটভাঙা শাড়ী। সকাল সকাল কাঁচা হলুদ গায়ে মেখে স্নান সেরে বাগদেবীর পুজোয় বসা। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড়, হাসি-ঠাট্টা। আমার-আপনার কাছে সরস্বতী পুজো মানে এসব হলেও, ওনাদের কাছে সরস্বতী পুজোর সংজ্ঞাটা একেবারে আলাদা।
পেশায় ওনারা মরশুমি শিল্পী। কিন্তু বাঙালির তো ১২ মাসে ১৩ পার্বণ। তাই বছরভর ব্যস্ত তারা। সামনে সরস্বতী পুজো। তারমধ্যে এখন আবার কচিকাঁচাদের নতুন ডিম্যান্ড। মূর্তি চাই কাস্টমাইজড। তাই সাধারণভাবে মূর্তি বানানোর পাশাপাশি চলছে ক্যটালগ দেখে মূর্তি বানানোর তোড়জোড়। এখানে যে এই কদিন কি বিশাল কর্মকান্ড চলে, সেটা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না।
চাকদার কুমোরপাড়া। শোনা যায়, সরস্বতী পুজো উপলখ্যে সবচেয়ে বেশি মূর্তি নাকি এই অঞ্চলেই তৈরি হয়। সুতরাং, শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা দেখে মনে হতে পারে, সামনে যেন মেয়ের বিয়ে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম- নিপুণ হাতে আর দুর্দান্ত সৃষ্টিতে, শিল্পকে পৌঁছেছেন বাংলার কোণে কোণে।
এখানকার মূর্তির চাহিদা নাকি সারা দেশজুড়ে। এদের হাতে তৈরি মূর্তি শুধু বাংলায় নয়, পৌঁছে যায় বাংলার বাইরেও, আসাম, বিহার, এমনকি ত্রিপুরাতেও। সারা চাকদহ জুড়ে রয়েছেন প্রায় ১০০রও বেশি মৃৎশিল্পী। আবার তাদের সাহায্য করার জন্য আছেন আরও প্রায় শ চারেক সহশিল্পী।
কেউ ছাঁচে ফেলে প্রতিমা গড়ছেন আবার কেউ ব্যবহার করছেন আধুনিক মেশিন। কেউ চোখ আঁকছেন, কেউ রং করছেন, কেউ কাপড় পড়াচ্ছেন আবার কেউ বা কাঁচা মাটির মূর্তি পুড়িয়ে টেরাকোটার রূপ দিচ্ছেন। সব মিলিয়ে চাকদার কুমোরশিল্পীদের দম ফেলার সময় নেই এখন।
মূর্তি তৈরির মূল কাঁচামাল হল মাটি। এই মাটির যোগান নিয়েও এক বিরাট সমস্যায় পড়েছেন এঁরা। মাটির যোগান না থাকায় ক্রেতাদের চাহিদাও সঠিকভাবে পুরণ হচ্ছে না। কাজ বন্ধ করে দিতে তারা বাধ্য হচ্ছেন।
পরিশ্রম বেড়েছে কিন্তু সেই অনুপাতে রোজগার বাড়েনি। সবথেকে বড় সমস্যা হল পরবর্তী প্রজন্ম নতুন করে এই পেশায় যুক্ত হতে একদম নারাজ। মুখ্যমন্ত্রী কিন্তু লোকশিল্পীদের জন্য শিল্পী ভাতা চালু করেছেন। তাহলে কি আধুনিক প্রজন্ম এই ভাতার ওপর ঠিক আস্থা রাখতে পারছে না ? নাকি এই ভাতার পরিমান আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যথেষ্ট নয়? তার ওপর এরা লেখাপড়া শিখছে। দিনের শেষে তারা চায় job security. যা এই শিল্পে একেবারেই নেই। নির্মম বাস্তবকে সঙ্গী করেই এখনও টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছেন তারা। কিন্তু এইভাবে কষ্ট করে আর কতদিন? কোনোদিন আবার বাংলার এই ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্প মৃত শিল্পে পরিণত হবে না তো?
সুব্রত সরকার
নদীয়া