Trending
২ হাজার টাকা থেকে ২ লক্ষ কোটি। বিজ্ঞাপনী প্রচারে অমিতাভ বচ্চনের মত প্রথম সারির বলিউড তারকা থেকে ভারতীয় ক্রিকেট দলের স্পন্সর। একটা সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলা। এই সবই এক জীবনে করতে পেরেছিলেন সাহারা কর্ণধার সুব্রত রায়। তৈরি করেছিলেন প্রায় ১৪ লক্ষ কর্মসংস্থান। আর এই তুমুল উত্থানে সঙ্গত ভাবে পাশে থেকেছে বিতর্ক। মুখে লেগেছিল কালি। খাটতে হয়েছিল জেল। কারণ পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি। কোটি কোটি বিনিয়োগকারীদের ভবিষ্যৎ এক নিমেষে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। এখনো কাটে নি সেই অনিশ্চয়তার ঘেরাটোপ। আর যে কারণে এবার উঠছে প্রশ্ন- তাহলে? আজকের প্রতিবেদনে নজর দেব সেই দিকে। তবে শুরু করা যাক সুব্রত রায়ের শুরুর দিনটা ধরে।
সুব্রত রায়ের উত্থান ছিল খানিকটা স্বপ্নের মত। স্বপ্নপূরণ করতে তাই সুব্রত রায় ছিলেন খানিক একবগগা। ১৯৪৮ সালে বিহারের আরারিয়াতে জন্মগ্রহণ করেন সুব্রত রায়। পড়াশোনা থেকে ব্যবসা। মাত্র ২ হাজার টাকা দিয়ে খুলেছিলেন এক ফিনান্স কোম্পানি। শোনা যায়, শুরুর দিনে তিনি থাকতেন এক উকিলের বাড়ি। একফালি ঘর নিয়ে। শোনা যায়, সেই সময় একটা ছোট অফিস ভাড়া নিয়ে তাঁর যাত্রাপথ শুরু। স্কুটারে করেই অফিস যাতায়াত করতেন। সেই সময় তাঁর লক্ষ্য ছিল মাইক্রো ফিনান্স। ছোট দোকানদারদের বাড়ি বাড়ি ঘুরতেন। আর ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের লাভ বোঝাতেন তিনি। এখানেই বলে রাখি, নিম্ন মধ্যবিত্তদের বিনিয়োগ ছিল সুব্রত রায়ের সংস্থা চালানোর আসল ভিত্তি। ১৯৭৮ সালে তৈরি হয় সাহারা গ্রুপ। লখনউ-এ অফিস তৈরি করেন ১৯৮৩-৮৪ সালে। তারপর সাহারা গ্রুপ এক সুবিশাল সাম্রাজ্যের পথে হাঁটতে শুরু করে। সাহারা এয়ারলাইন্স, রিয়েল এস্টেট, টিভি চ্যানেল- সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে সাহারা গ্রুপ।
একটা সময় টাইম ম্যাগাজিনে পাবলিশ হয়, রেলের পর সাহারা গ্রুপই ছিল যে প্রায় ১৪ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছিল। সাহারার রিয়েল এস্টেট ব্যবসার মোস্ট অ্যাম্বিশাস প্রোজেক্ট হল অ্যাম্বি ভ্যালি সিটি। এছাড়া ২০০১ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিমের স্পন্সর ছিল সাহারা গ্রুপের। বিজ্ঞাপনের মুখ ছিলেন অমিতাভ বচ্চন। তখন সর্বত্র সাহারা গ্রুপের জয়জয়কার। ২০০৪ সালে সুব্রত রায় যখন দুই ছেলের বিয়ে দেন, তখন নাকি এক সপ্তাহ ধরে চলে সেই বিয়ের অনুষ্ঠান। ১০ হাজার মানুষ নিমন্ত্রিত ছিলেন। বলিউড, রাজনীতি, ক্রিকেট, কর্পোরেটের তাবড় মাথারা উপস্থিত ছিলেন সেই বিয়েতে। কিন্তু সাহারা গ্রুপের এই আকাশচুম্বী পপুলেশনের কারণ কী? কিভাবে একটি সংস্থা ধীরে ধীরে চারা থেকে বটবৃক্ষ হয়ে ওঠে? সেই বেড়ে ওঠাতে কোন মিথ্যাচার নেই তো? নজর দেয় সেবি। তবে সাহারা গ্রুপকে বড়সড় ধাক্কা দেয় একটা চিঠি। আর সেটাই কার্যত বদলে দেয় সাহারার ভাগ্যচক্র।
২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি। ডেটটা খেয়াল রাখবেন। এই দিন রোশন লালের নামে একটি চিঠি এসে পৌঁছয় ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্কে। চিঠিতে রোশন লাল একটা বড় ধরণের অভিযোগ নিয়ে আসেন। অভিযোগটা ঠিক কী? ঐ চিঠিতে রোশন লাল ন্যাশনাল হাউজিং ব্যাঙ্ককে অনুরোধ জানিয়েছেন সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কর্পোরেশন এবং সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনের বন্ড নিয়ে তদন্তের জন্য। তিনি বলেন, নিয়ম মেনে নাকি সেই বন্ড ইস্যু করাই হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই সেই চিঠি পৌঁছে যায় সেবির কাছে। ওদিকে আবার সেবি আমেদাবাদের অ্যাডভোকেসি গ্রুপ ফর ইনভেস্টমেন্ট প্রোটেকশনের কাছ থেকেও একটি চিঠি পায়। ২০১১ সালে সেবির একেবারে রোষ নজরে পড়ে সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কর্পোরেশন লিমিটেড এবং সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড। সেবি জানায় ৩ কোটি মানুষের কাছ থেকে যে টাকা সাহারা গ্রুপ নিয়েছে সেটা নাকি একেবারেই বেআইনি। অতএব ৩ কোটি বিনিয়োগকারীদের ঐ টাকা ফেরত দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়। তার জন্য ওএফডিসি বন্ডের মাধ্যমেই ফেরত দিতে হবে টাকা।
শুরু হয় দীর্ঘ আইনি লড়াই। আর এটাই পরিচিতি পায় দ্য সাহারা স্ক্যাম নামে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট সাহারার সকল বিতর্কে জল ঢেলে দেয়। সেবির নির্দেশ বহাল রেখেই জানায় সুদ সহ বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দিতে হবে তাও ১৫ শতাংশ হারে। তার জন্য সুপ্রিম কোর্ট একটি জয়েন্ট রিফান্ড অ্যাকাউন্ট খোলার নির্দেশও দেয়। সেবির কথা সাহারা শোনে নি। বরং সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল ৯৪% বিনিয়োগকারীরা নাকি টাকা ফেরত পেয়ে গেছেন। কিন্তু সেবির একটা রিপোর্ট বলছে, সাহারা মাত্র বিনিয়োগকারীদের ১৩৮ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। বাকি ২৪ হাজার কোটি টাকা এখন সুদে আসলে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তাহলে এখন প্রশ্ন এই ২৫ হাজার কোটি টাকা কি হবে? সাহারার বারো ভূতে খাবে নাকি যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিয়ে বিনিয়োগকারীদের ফেরত দিয়ে দেওয়া হবে? এখানেই জানিয়ে রাখি, সাহারা গ্রুপের চারটি সংস্থায় বিনিয়োগ ৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত দেবার জন্য তৎপর হয় কেন্দ্র। সেই সময় খোলা হয় সিআরএস-সাহারা রিফান্ড পোর্টাল। যেখানে নথিভুক্ত হয়েছে ১৮ লক্ষ মানুষের নাম। কেন্দ্র আশ্বাস দিয়েছিল ১০ কোটি বিনিয়োগকারির টাকা ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু ঐ আশায় বাঁচে চাষা। বন্ড হোল্ডাররাও নীরব, বিনিয়োগকারীদের নাকি খোঁজই মেলেনি।
মঙ্গলবার রাতে মৃত্যু হয়েছে সাহারা কর্ণধার সুব্রত রায়ের। মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে তিনি মারা গিয়েছেন। দীর্ঘ রোগভোগের শিকার হয়েছিলেন সুব্রত রায়। একটা সময় যাকে প্রতিদিন লাইম লাইটে দেখা যেত, শেষের দিকে সেই তিনিই চলে গেছিলেন একেবারে আলোর পিছন দিকে। অন্তরালে থেকেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তারপরেই সাহারা স্ক্যাম এবং ২৫ হাজার কোটি টাকার ভবিষ্যৎ নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। আপনাদের কাছেও জানতে চাইছি, এই বিপুল টাকা কি আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে নাকি সাহারার বারো ভূতে খাবে? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক করুন, শেয়ার করুন। আর ভুলবেন না সাবস্ক্রাইব করতে আমাদের চ্যানেল বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ