Trending
স্পেস রিসার্চ ইন্ডাস্ট্রিতে গোটা বিশ্ব তখন ভারতবিমুখ। মুখ ফিরিয়েছে আজকের বন্ধু আমেরিকাও। অথচ, অন্ধের যষ্টির মত তখনও ভারতের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রাশিয়া। ভারত আর রাশিয়া যে গলায় গলায় বন্ধু, সে প্রমাণ দিচ্ছে খোদ ইতিহাস। তাহলে আজ হঠাৎ এমন কী হল যে স্পেস রেসে আদা-জল খেয়ে ভারতের পিছনে পড়ল রাশিয়া? ভারত আর রাশিয়ার সম্পর্কের সমীকরণটা ঠিক কী? ভারতকে তো তারা বন্ধু বলে, তাহলে তাকে হঠাৎ টেক্কা দেওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কোথা থেকে?
১৯৭৬-এর পর কেটে গিয়েছে ৪৭ বছর। অথচ এই এতগুলো দিন ধরে চাঁদ ছোবার কোন বাসনাই ছিল না রাশিয়ার। আগাম কোন ঘোষণা ছাড়াই লুণা-২৫-কে লঞ্চ করলো মস্কো। কখন? ভারত চন্দ্রযান-৩ লঞ্চ করে চাঁদে পাঠানোর পর ঠিক ১০-১১ দিনের মাথায়। উঠলো বাই তো কটক যাই গোছের প্ল্যানিং এবং একজিকিউশন ছিল যাত্রা শুরু করলো রাশিয়ার লুনা-২৫। উদ্দেশ্য, ভারতের আগে চাঁদে পৌঁছনো। কেন? ভারতের আগে পৌঁছলে রাশিয়ার কী লাভ? কোইনসিডেন্স? নাকি লুনা মিশনের কাঁধে বন্দুক রেখে ভারতকে কোন মেসেজ দিতে চাইল রাশিয়া?
পৃথিবীর হাজারও সমস্যা সমাধানের বালাই নেই। অথচ বিশ্বজুড়ে হঠাৎই জেগে উঠলো চাঁদে যাওয়ার ধুম। যদিও চাঁদকে ঘরে আনার স্বপ্ন আপাতত অধরাই থাকলো রাশিয়ার। চাঁদের কাছাকাছি গেল, কিন্তু কাছে পৌঁছতে পারল না। সুতরাং ব্যর্থ হল রাশিয়ার চন্দ্রাভিযান। স্পেস রেসে টিকে রইলো ভারত। কিন্তু রেসটা শুধু স্পেস রেসই তো? নাকি এর জিওপ্লিটিক্যাল ইম্পরট্যান্সও কিছু রয়েছে? সে বিষয়ে আসছি।
তার আগে ছোট করে বলে দেওয়া যাক, কেন ক্র্যাশ করলো রাশিয়ার লুনা-২৫। জানা গিয়েছে, ল্যান্ডিং-এর আগে কন্ট্রোলিং অরবিট থেকে অন্য অরবিটে পাঠানোর সময় একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ফেস করে লুনা-২৫। এরপরই ঘনিয়ে আসে বিপর্যয়। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ। রাশিয়া জানিয়েছে, লুন-২৫ একটা আন্সারটেন অরবিটে ঢুকে পড়েছিল, যার ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলা যায় না। আর সেইজন্যেই ঘটে মিসক্যালকুলেশন এবং ক্র্যাশ করে মহাকাশযানটি।
এত বড় একটা মিশন ফেইল হয়ে যাওয়া মানে একটা বিশাল অঙ্কের আর্থিক নয়ছয় তো বটেই। তাছাড়াও পুতিনের ইমেজটা যে কতটা ডাউন হল! মিশন একজিকিউট করার পিছনে তো রাশিয়ার কিছু অ্যাজেন্ডা ছিল নিশ্চয়ই। সেটা কী? প্রথমত, বিশ্বমঞ্চে রাশিয়ার ইমেজটা রিক্রিয়েট করা। মানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের এতগুলো দিন পরে গোটা বিশ্বের কাছে রাশিয়ার তো বিশেষ সুনাম আছে বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া যে সমস্ত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা প্রেডিক্ট করেছিলেন যে, এতদিন ধরে যুদ্ধে ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে রাশিয়া, হয়ত কোনোদিন দেউলিয়া তকমা লাগবে পুতিন রাষ্ট্রে। সেই সমস্ত অর্থনীতিবিদদের কাছে এই ১৬ হাজার কোটির প্রজেক্ট একটা সপাট জবাব তো বটেই। ভাবতে পাচ্ছেন? শুধু হারিয়ে যাওয়া ফেম ফেরত পেতেই রাতারাতি ১৬ হাজার কোটির মিশন লঞ্চ করলো দেশটা। আরও আছে। আসল অ্যাজেন্ডা তো মিস করে যাচ্ছেন।
রাশিয়াই প্রথম দেশ যারা এই স্পেস ইন্ডাস্ট্রির ফিউচারটা দেখেছিল এবং তার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিল। সবার প্রথম মহাকাশযান পাঠায়, রাশিয়া। সবার প্রথম মহাকাশচারি পাঠায়, রাশিয়া। তবুও বিশ্ববাসী শুধু নাসার জয়জয়কার করবে? বিশ্বগুরু হবে আমেরিকা? আর পুতিন চুপ করে বসে বসে দেখবে? ইমেজের বারটা পাঁচ কে বাজাতে চায়? কিন্তু ফেম কুড়োতে গিয়ে গেম চেঞ্জ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা- এটা আনএক্সপেক্টেড। প্রশ্ন হচ্ছে, বাসনাটা চাঁদ ছোঁয়ার ছিল নাকি বিশ্বগুরু তকমা পাওয়ার ছিল? আসলে যুদ্ধক্ষেত্রের মত মহাকাশেও একতরফা ডমিন্যান্স দেখাতে চেয়েছিল রাশিয়া। আচ্ছা, চাঁদে পৌঁছতে ভারতের যে রাস্তা পেরতে ৪০ দিন সময় লাগছে, সেখানে সেই একই রাস্তা পৌঁছতে রাশিয়ার সময় লাগছিল মাত্র ১০ দিন? কেন? চাঁদ কি রাশিয়া থেকে বেশি কাছে? চলুন, বিষয়টার আরেকটু ভিতরে ঢোকা যাক।
ফিনান্স সাপোর্ট স্ট্রং না হলে এত বড় রিস্ক নেওয়া যায় না। সুতরাং, এই সাহস দেখাতে পারার প্রাইমারি রিজন বাজেট। লুনা-২৫ জন্য রাশিয়া ইনভেস্ট করেছিল ১৬হাজার কোটি টাকা। চন্দ্রযান-৩ তৈরি করতে ভারত সরকার বরাদ্দ করেছিল মাত্র ৬১৫ কোটি টাকা। সেকেন্ড হচ্ছে ফুয়েল। রাশিয়া এক্ষেত্রে দুনিয়ার সবচেয়ে পাওয়ারফুল রকেট সুইজ রকেট ব্যবহার করে। যে জ্বালানির সাহায্যে চাঁদে এগোনোর জন্য প্রয়োজনীয় এনার্জি নিজেই জোগাড় করে নিতে পারে। অন্যদিকে এই একই কাজের জন্য ভারতের PSLVC3-কে ভরসা করতে হয় গ্র্যাভিটির ওপর। পাওয়ার এবং টেকনলজির দিক থেকে সত্যিই অনেক এগিয়ে রাশিয়া। তৃতীয়ত, ওজন। ভারতের তৈরি চন্দ্রযান-৩ রাশিয়ার লুনা-২৫-এর থেকে প্রায় দ্বিগুন ভারী। সুতরাং, লুনা-২৫-র সময় কম লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এত তোড়জোড় এত তাড়াহুড়ো- সবটাই জলে ভেসে গেল।
স্পেস রেসে টিকে রয়েছে ভারত। যদিও ভারত কোনোদিন কোন রেসে জড়িয়েছিল কিনা, সেটাই একটা বড় প্রশ্ন। কারণ এসমস্ত প্রত্যাশা যদি সত্যিই ভারতের থাকত, তাহলে চন্দ্রযান-২ ফেল হবার ৬ মাসের মধ্যেই চন্দ্রযান-৩ লঞ্চ করতে পারত। সেই সাপোর্টটা ভারতের ছিল। কিন্তু, ইসরো অপেক্ষা করেছে। রাশিয়া তো হেরে গেল। ভারত কী জিততে পারবে? দেখুন, জিতে যাওয়ার সংজ্ঞাটা আপনার কাছে কী তার উপর ডিপেন্ড করছে এর উত্তর। সবচেয়ে কম বাজেটে চাঁদে ল্যান্ড করা যদি জয় হয়, তাহলে ভারতের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়াকে যদি হয় পাওয়া বলা হয়, তাহলে হ্যাঁ, ভারতের জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এতবার সফলতা পাওয়া দেশটাও কিন্তু ব্যর্থ হল। ওভারকনফিডেন্স? তবে হ্যাঁ! হতে পারে, রাশিয়ার এই মিশন ব্যর্থ। কিন্তু ভারতের সামনে তারাই রেখে গেল বেশ কিছু প্রশ্ন। এতগুলো বছর পরেও হাই ক্যাপাসিটির রকেট তৈরির দিকে ভারত এগোতে পারল না কেন? স্লো অ্যান্ড স্টেডি উইন্স দ্য রেস বলে গা বাঁচিয়ে আর কতদিন? R&D-এর জন্য সাফিসিয়েন্ট বাজেট নেই বলে কেন হাপিত্যেশ করতে হয় ভারতকে? বিলিয়ন ডলারের এত বড় একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কেন এখনও একটা স্মল পার্ট হিসেবেই পড়ে রয়েছে ভারত? আল্টিমেটলি তো স্পেস রেস নিজের বেটারমেন্টেরই একটা যুদ্ধ। ভারত সরকারের কি এই বিষয়ে আরও চৌকশ হওয়া উচিৎ নয়?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ।