Daily
রক্ত চন্দন কাঠের অবৈধ পাচার করে গোটা দেশে হুলুস্থুলু ফেলে দেয় রিল লাইফের পুষ্পা রাজ। কিন্তু এখানেই মনে হয় রয়েছে রিল এবং রিয়াল লাইফের এক ভালোরকম ফারাক। কারণ জঙ্গল থেকে কাঠ নিয়ে আসার বিষয়টা বাংলার মানচিত্রে নতুন নয়। আর সেই ছবিটাই বিজনেস প্রাইম নিউজের ক্যামেরায় ধরা পড়ল যখন আমাদের প্রতিনিধি হাজির হলেন মাইডি জঙ্গলে। যেখানে জঙ্গলের কাঠ সত্যিই বাড়িতে নিয়ে আসছে পুষ্পা। তবে বৈভবের টানে নয়। পেটের জ্বালা মেটাতে।
দুর্গাপুর-ফরিদপুর ব্লকের ঘন জঙ্গল। নেকড়ে বাঘ, হায়না, শিয়াল তো রয়েছেই। সঙ্গে এই জঙ্গলে পদে পদে অপেক্ষা করে থাকে বিষধর সাপ। কিন্তু পেটের টান যে বড় টান। ভয়, আতঙ্ক সবকিছুকে সরিয়ে রেখে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দাপিয়ে বেরাচ্ছে পুষ্পার ২০ জনের দল। এদের কেউ পড়ে ক্লাস ওয়ানে, কেউ বা পড়ে ক্লাস নাইনে। তীব্র আর্থিক অনটনের মধ্যে পড়ে সংসারের হাল ধরতেই তারা জঙ্গলে ঢোকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করার জন্য। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত সবকিছুকেই উপেক্ষা করে চলে তাদের কাঠ সংগ্রহের কাজ। প্রতিদিন এই ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোকে কাঠ সংগ্রহ করতে প্রতিদিন পায়ে হেঁটে দু-তিন কিলোমিটার জঙ্গলের গভীরে ঢুকতে হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে তাদের এই কাজ। কিন্তু কেন কাঠ সংগ্রহ করতে এই ছোট্ট শিশুদের জীবন বাজি রাখতে হয়?
আর শুধু পুষ্পা নয়। শৈশব হারিয়ে সংসারের এই কাজ সামলাচ্ছে পুষ্পার বেশ কয়েকজন বন্ধুরা। তাদের মধ্যে যেমন রয়েছে পুনম, ললিতা, সুনিতা, করিনা, রেশমা, রাজ, রাধিকা বা সুমনের মতন ২০ জন। এদের বাবা-মায়েরা অনেকেই মোরাম খাদানের শ্রমিক। দু’জন মিলে একসঙ্গে এই পরিশ্রমের কাজ করে যেটুকু আয় করতে পারেন, তাই দিয়ে কোনরকমে পেট ভর্তি করার সামগ্রীটুকু জুটিয়ে নেন তাঁরা। আর দিনভর হারভাঙ্গা পরিশ্রমের পর যখন তাঁরা বাড়িতে আসেন, তখন শৈশবের হাসি ভুলে থাকা এই কচিকাঁচারাই খাবার তুলে দেয় বাবা-মায়েদের হাতে।
কিন্তু বাবা-মায়ের যে কিছুই করার নেই। কারণ রান্নার গ্যাস- সে যে বহুত দূর কি বাত। কারণ স্বস্তি দিতে রান্নার গ্যাস ব্যাবহার করারও উপায় নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের উজ্জ্বলা যোজনার রান্নার গ্যাস সেটাই তো এদের কাছে মরীচিকার সামিল।
গ্রীষ্মের ছুটির সময় আর বর্ষার আগে পুষ্পার দল কাঠ কাটতে পৌঁছে যায় গভীর জঙ্গলে। এলাকা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ঘন সোনাঝুরী গাছের জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে তারা। জানা গিয়েছে, দুর্গাপুর পুরসভা এবং ইছাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সীমানাবর্তী মোরাম খাদান এলাকায় বসবাস করে কয়েক হাজার দরিদ্র পরিবার। প্রায় সকলেরই বাড়ি মাটির। এই পরিবারের মহিলা, পুরুষ সকলে এই মোরাম খাদানের কাজ করে থাকেন। দুর্গাপুরের বন দফতর বলছে, এই এলাকায় গাছ চুরি হয় না ঠিকই। এই শুকনো কাঠ তারা যে সংগ্রহ করছে সেটা কোন আইনত অপরাধ নয়। কারণ সরকারি আইনে বলছে, জয়েন্ট ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট কমিটির রেজুলেশন বলা রয়েছে ওই শুকনো কাঠ সংগ্রহ করা তাদের অধিকার জ্বালানির জন্য। কিন্তু কাঠের আগুন প্রতিদিন যখন এদের সংসারে জ্বলে ওঠে রান্নার জন্য, তখনও পেটের এই জ্বালা ভুলিয়ে দেয় গ্যাস না-থাকার কথা। কারণ খিদের জ্বালা যে বড় জ্বালা। তাকে অগ্রাহ্য করবে কে? সংসার যখন নিজেই দাঁড়িয়ে রয়েছে দারিদ্র্যের একেবারে খাদে তখন কাঠ সংগ্রহ করেই ভরাতে হবে পেট। জীবনের ঝুঁকি থাকলেই বা কি? দুর্গাপুরের এই কচিকাঁচার দল শৈশব এবং ভালো পড়াশুনোর ইচ্ছা সবই জলাঞ্জলি দিয়ে ওরা ঢুকে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে। ওরা সরকারের সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করে না। ওরা শুধু কাজ করতে জানে। ওরা কাজ করে।