Daily
কৃষিকাজ নিজেই একটি বিজ্ঞান। কিন্তু প্রযুক্তির দৌড়ে তাল রাখতে গিয়ে হয়ত কিছুটা পিছিয়েই পড়ছে কৃষিকাজের সামগ্রিক ছবিটা। আর যে কারণে বর্তমান জেনারেশন আগ্রহ হারাচ্ছে কৃষিকাজে। কারণ একটাই। প্রফিট মার্জিন তেমন থাকছে না। উৎপাদনেও রয়ে গিয়েছে ঘাটতি। তাই কৃষকদের মধ্যে প্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানের সম্মিলিত প্রয়াস যদি নিয়ে আসা যায়, তাহলে আখেরে উন্নতি হবে সামগ্রিক কৃষিকাজের। আর কৃষিকাজের উন্নতি তখন হবে, যখন কৃষক নিজেও লাভের অঙ্ক ভালোরকম দেখতে পাবে। কিন্তু কৃষিকাজের সামগ্রিক ছবিটা তুলে ধরার জন্য কি কি প্রয়াস নেওয়া হচ্ছে? কারাই বা নিচ্ছে সেই প্রয়াস?
এখানেই আসছি সেই যৌথ প্রচেষ্টার শুরুতে। লক্ষ্য হচ্ছে প্রকৃতি বান্ধব চাষ, মাটির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার এবং বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন। কৃষিকাজের জন্য সেটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে ঠিকই। কিন্তু এই অসাধ্য সাধন করবে কারা? নদিয়ার কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের সঙ্গে ইনহানা অর্গানিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং বিশ্বখ্যাত তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা আইবিএম। এই সুবিশাল প্রজেক্টে শুরু হয়েছিল ২০২০ সালে। পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ার হরিণঘাটা ফতেপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের পাঁচটি গ্রামে ক্লিন ফুড প্রোগ্রাম শুরু করে আইওআরএফ এবং নদিয়ার কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র। এই বিশাল কর্মকাণ্ড তখন নজরে আসে আইবিএমের। তারাও বুঝতে পারে এই প্রোগ্রামের গুরুত্ব কতটা। আর যে কারণে ২০২১ সালে তারা এই প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত হয়। তৈরি হয় আইবিএম-আইওআরএফ সাস্টেনিবিলিটি প্রোজেক্ট। সম্প্রতি এই প্রজেক্টের ফার্স্ট ফেজের কাজ শেষ হয়েছে। এবার চলছে দ্বিতীয় ফেজের কাজ। আর ফার্স্ট ফেজ শেষ হওয়া উপলক্ষ্যে ভবানীপুর, সত্যপোল, বাঁশবোনা, পাঁচ কাহানিয়া এবং ধোপাগাছির ৪০০ কৃষকদের নিয়ে আয়োজিত হল ক্লিন ফুড অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে পরিচালনা এবং বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, প্ল্যান্ট হেলথ এবং সয়েল ও বাজার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন ইনহানা অর্গানিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন এবং নদিয়ার কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। এই প্রোজেক্টের আসল উদ্দেশ্য কি সেই বিষয়ে বিস্তারিত বললে ইনহানা অর্গানিক রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সাইন্টিফিক প্রোজেক্টসের হেড ডক্টর অন্তরা শীল।
কম্পোস্ট সার – রাসায়নিক সার, রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে। ভবানীপুর, সত্যপোল, বাঁশবোনা, পাঁচ কাহানিয়া এবং ধোপাগাছির কৃষকদের কাছ থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। বিশ্লেষণ করা হয় মাটিতে থাকা ২৫ টি ভৌত, রাসায়নিক এবং জৈবিক উপাদানের। এই আলোচনা সভায় ১০০ জন কৃষকদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সয়েল হেলথ কার্ড। এর মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই বুঝতে পারবেন মাটির এবং ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী সারের প্রয়োগ সম্পর্কে। ফলে সারের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার কমবে। কমবে ক্ষতিকারক প্রভাব। বৃদ্ধি পাবে ফসলের উৎপাদন। হ্রাস পাবে উৎপাদনের খরচা।
এই সুবিশাল কাজটি করার জন্য প্রযুক্তির প্রয়োজন পড়বে ভালোরকম। কম্পিউটার টেকনোলজি ব্যবহার করে কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই বার্তা। যে কারণে আইবিএম এর এগিয়ে আসাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু আইবিএম এই প্রজেক্ট সম্পর্কে জানতে পারল কি করে আর কিভাবেই বা যুক্ত হতে পারল?
আজ অধিকাংশ চাষিদের কাছে ফোন রয়েছে। তাদের কাছে রয়েছে ইন্টারনেট কানেকশন। আর যদি কোন কৃষকের প্রয়োজন পড়লে ল্যাবে গিয়ে বা রিসার্চ সেন্টারে গিয়ে টেস্ট রিপোর্ট নিয়ে আসা সম্ভব না হয়, সেই কারণে কৃষকদের অনলাইন সিস্টেম প্রোভাইড করবে। যেখানে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তারা নিজেরাই মাটির টেস্ট রিপোর্ট দেখে নিতে পারবেন। মানে কিভাবে উন্নত পদ্ধতির কৃষিকাজ করা একজন চাষির পক্ষে সম্ভব, সেটা মোবাইলের ঐ এক ক্লিকেই তারা জেনে নিতে পারবেন। বলা বাহুল্য যে, এই বিষয়টি নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। আইবিএমের এই আন্তরিক সহযোগিতায় এবং আইওআরএফের সঙ্গে নদিয়ার কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র যদি সমানতালে এই গোটা কর্মকাণ্ডটি চালিয়ে যেতে পারে, তাহলে এই প্রজেক্টটি আর স্রেফ বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্যান ইন্ডিয়ার সকল কৃষকরাই ভালোরকম লাভবান হবেন। তবে এখানেই শেষ নয়। আইওআরএফ প্রকল্পটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নামছে। বিষমুক্ত দেশি সবজি বীজ, বিষমুক্ত বিভিন্ন প্রজাতির ধান বীজ তৈরীর প্রকল্প তারা হাতে নিচ্ছে। মাটি পরীক্ষা থেকে এই গোটা প্রকল্পকে এখন হাতে-কলমে শেখানো হচ্ছে চাষিদের। উপকৃত হচ্ছেন তাঁরাও। আর সার্বিকভাবে উপকৃত হবে দেশের কৃষিকাজ। উদ্যোক্তারা আশাবাদী, আইবিএমের হাতে ধরে থাকলে একদিন সারা দেশের মানুষ হাতে এবং পাতে পাবেন বিষমুক্ত ফসল এবং খাদ্য।
সুব্রত সরকার
নদিয়া