Trending
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি বৈঠক সারেন মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলার সঙ্গে, কেন? এছাড়াও মোদী যতবারই বিদেশ ভ্রমণ করেছেন, সেই দেশের প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। নিজের বক্তব্য রেখেছেন, কেন? আজ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পপুলারিটি বিশ্বের সকল শীর্ষ নেতাদের থেকে অনেকটাই বেশি। সুতরাং, প্রবাসী ভারতীয়দের কাছে মোদীকে নিয়ে আলাদা আবেগ কাজ করে। প্রধানমন্ত্রী প্রবাসী ভারতীয়দের সঙ্গে যেভাবে দেশের সার্বিক উন্নতির বিষয় নিয়ে আলোচনা সারেন, একইসঙ্গে নিজের বক্তব্য রাখেন, সেটা বিশ্বনেতাদের কাছেও বেশ প্রশংসনীয় একটা বিষয়। যদিও অনেকেই মনে করেন, প্রবাসে চলে যাওয়া মানেই তো ভারতীয় মেধা বিদেশের মাটিতে গিয়ে নিজের কর্মভাগ্যের চাকা মসৃণ করছে। এতে ভারতের কোন লাভের লাভ হচ্ছে কি? তাহলে জবাব হচ্ছে হ্যাঁ। শুধু ভারতীয় সংস্কৃতি বলেই নয়, ভারতের অর্থনীতির জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের ভূমিকা অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাই আজকের প্রতিবেদনে বলব, ভারতীয় অর্থনীতিতে প্রবাসী ভারতীয়দের ভূমিকা কতটুকু? একইসঙ্গে বলব, অর্থনীতির গণ্ডি পেরিয়েও প্রবাসী ভারতীয়রা কিভাবে ভারতকে জিওপলিটিক্সে শক্তপোক্ত স্ট্যান্ডপয়েন্ট ধরে রাখতে সাহায্য করে।
আমরা সকলেই জানি, সম্প্রতি প্রবাসী ভারতীয় দিবস কনভেনশন অনুষ্ঠিত হল তিনদিন ব্যাপী। মূলত ৯ জানুয়ারি উপলক্ষ্যে এই সম্মেলন করা হয়। কেন? ইতিহাস বলছে, মহাত্মা গান্ধী ১৯১৫ সালে ৯ জানুয়ারি সাউথ আফ্রিকা থেকে ভারতে পা রেখেছিলেন। তাই এই দিনটিকে প্রবাসী ভারতীয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। এখন বিষয় হচ্ছে, কেন্দ্রে মোদী সরকার আসার পর কেন বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে প্রবাসী ভারতীয়দের নিয়ে? তার অনেকগুলো কারণ রয়েছে। প্রথমেই বলি, বিশ্বে অন্যান্য দেশের থেকে প্রবাসী ভারতীয়দের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। মানে পৃথিবীর যে দেশেই যান না কেন, ভারতীয়র দেখা পেয়ে যাবেনই যাবেন। আর এটাই ভারতের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, প্রবাসী ভারতীয়রা ভারতের সঙ্গে বিদেশের মধ্যে একটা ব্রিজ তৈরি করেন। যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ভারতের সার্বিক উন্নতির বিষয়টাও উঠে আসে। একইসঙ্গে প্রবাসে থাকে ভারতীয়রা নিজের জন্মভূমি নিয়ে আলাদা আবেগ বজায় রাখেন। সেটাই প্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যে আলাদা করে ভারতীয় সংস্কৃতিকে বিশ্ব দরবারে আরও ছড়িয়ে দেবার তাগিদ লক্ষ্য করা যায়। এর ফলে বিশ্ববাসী যারা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তেমন একটা ওয়াকিবহাল নন, তাঁরাও ভারতের সুপ্রাচিন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। একইসঙ্গে ভারতের র্যাপিড ইকোনমিক গ্রোথের সঙ্গেও তাঁদের যোগাযোগ তৈরি হয়। বিশ্বের মধ্যে একমাত্র ভারতই একটি দেশ, যেখানে সবরকমের সম্ভাব্য বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা সম্ভব। সেটা বিদেশিদের জন্য ভারতের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে অনেকটা কাজ করে।
সংস্কৃতির কথা যদি একটা পাশে সরিয়ে রাখি, তাহলে বলব, প্রবাসী ভারতীয়রা ইন্ডিয়ান ইকোনমিকে মজবুত করার কাজটা করেন। ভারতের বাইরে থেকে নিজের নিজের দক্ষতা প্রমাণ করে প্রবাসী ভারতীয়রা যে কর্মযজ্ঞ চালান, তার সুফল পায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। কারণ প্রবাসীরা বিদেশ থেকে যে অর্থ রোজগার করেন, তারই কিছুটা তাঁরা পাঠান ভারতে নিজের নিজের ফ্যামিলির কাছে। আর এই সকল রেমিট্যান্স মিলেই দিনের শেষে দেখা যায়, রিজার্ভ ব্যাঙ্কে ফরেন রিজার্ভের অঙ্কটা সিন্ধুতে গিয়ে দাঁড়ায়। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২২ সালে শুধু প্রবাসী ভারতীয়দের হাত থেকে ফরেন রিজার্ভ এসেছে ১০০ বিলিয়ন ডলার মতন- গোটা বিশ্বে যা সর্বাধিক। ফরেন রিজার্ভ যত বাড়বে ভারতের অর্থনীতি ততই মজবুত হবে। কারণ বিশ্ববাণিজ্য করার জন্য কোন দেশের হাতে ফরেন রিজার্ভ থাকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যে দেশের হাতে যত বেশি ফরেন রিজার্ভ থাকে, সেই দেশ ততবেশি আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়। না-হলে সেই দেশের আর্থিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। তার টাটকা উদাহরণ দেখতে পাবেন শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে। এই দুটো দেশে ফরেন রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকে। ফলে ইমপোর্ট করার মত টাকা না-থাকলে তখন দেশের বাজারে মূল্যবৃদ্ধি অবশ্যম্ভাবী। বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের দিক থেকে দেখলে ভারত রয়েছে বিশ্বের চতুর্থ স্থানে। চিন, জাপান এবং সুইজারল্যান্ডের পর ভারতের হাতে রয়েছে ফরেন রিজার্ভ। বর্তমানে ভারতের হাতে রয়েছে ৫৬১ বিলিয়নের বেশি ফরেন রিজার্ভ। যা দেশের যে-কোন আর্থিক সংকটকে মোকাবিলা করার কাজটা করতে পারবে। তবে শুধু রেমিট্যান্স নয়। প্রবাসী ভারতীয়দের দৌলতে স্টার্ট আপের সংখ্যাও বহুগুণ বাড়তে পারে বলে আশাবাদী কেন্দ্রীয় সরকার। সম্প্রতি যে প্রবাসী ভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হল, সেখানে ভারতে স্টার্ট আপ খোলার জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের যোগদান করতে বিশেষ উৎসাহিত করছে ভারত সরকার। এর ফলে প্রবাসী ভারতীয় এবং ভারতবাসী একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারবেন। দেশের সমস্যা মেটাতে এবং আর্থিক পরিকাঠামো তৈরিতে ভারতের স্টার্ট আপগুলো অনেকটাই ফ্রন্টফুটে থাকে। এখন ভারত স্টার্ট আপ তৈরিতে এগিয়ে রয়েছে অন্যান্য অনেক দেশের থেকেই। যাদের মধ্যে কয়েকটি ইউনিকর্নের তকমাও পেয়েছে। সুতরাং স্টার্ট আপ চেনকে মজবুত করার বিষয়ে সাহায্য করেন প্রবাসীরাই। কারণ তাঁদের দৌলতে দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের চাকা আরও দ্রুত গড়াতে থাকে। শুধুমাত্র ভারতীয়দের হাত ধরে স্টার্ট আপ করে অন্য একটি দেশের সঙ্গে যত না ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব, প্রবাসী ভারতীয়দের উপস্থিতি সেই কাজটা আরও সহজ করে দেয়। ফলে, প্রবাসী ভারতীয়দের ইন্ডিয়ান স্টার্ট আপে যোগদান করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে মোদী সরকার।
প্রবাসী ভারতীয়দের গুরুত্ব এখানেই শেষ নয়। দেশের বাজারে উৎপন্ন সামগ্রীকে বিদেশের বাজারে ছড়িয়ে দিতে একমাত্র প্রবাসী ভারতীয়রাই সবথেকে ভালোভাবে করে থাকেন। তাঁরাই হচ্ছেন ভারতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। সুতরাং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ বা ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর মতন যে স্বপ্ন বোনার কাজ শুরু হয়েছিল, প্রবাসী ভারতীয়দের হাত ধরে বিদেশের বাজারে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি পণ্যের চাহিদা ছড়িয়ে সেই স্বপ্নকে সত্যি করার কাজটা আরও সুবিধের হয়ে যায়। এছাড়াও আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স, নতুন টেকনোলজি বা বিদেশের বিভিন্ন নলেজকে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটাও ভালোভাবে করতে পারেন প্রবাসী ভারতীয়রা। আমরা সকলেই জানি আজ ইন্ডিয়া শুধু ইন্ডিয়া নয়। ডিজিটাল বিপ্লব ঘটে গেছে এই দেশে। সেটা বিশ্বব্যাপী প্রত্যেকটা দেশই জানে। কিন্তু জানলেই তো হল না। ভারতের ডিজিটাল বিপ্লবের ঢেউ তো ছড়িয়ে দিতে হবে বিদেশে। আর যে কারণে সত্য নাদেলার সঙ্গে বৈঠক সারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যেহেতু সত্য নাদেলা নিজে একজন ভারতীয়, তাই ভারতের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করার জন্য বা বলা ভালো মাইক্রোসফটকে ভারতের সঙ্গে আরও ভালো করে জুড়ে দেওয়ার কাজটা ইনি ছাড়া কেই বা ভালো করে করতে পারবেন? কিন্তু এখানে এসেও প্রবাসী ভারতীয়দের গুরুত্ব থেমে থাকে না। বরং ইন্ডিয়ান ইকোনমিকে অন্য একটি সেক্টরে বুস্ট আপ করার কাজ করে থাকেন প্রবাসী ভারতীয়রা। যেমন, পর্যটন। অতিমারির ধাক্কা সামলেও ২০২১ সালে ভারত শুধুমাত্র পর্যটন খাত থেকে আয় করেছিল ৯ বিলিয়ন ডলার মত। যার ম্যাক্সিমাম কন্ট্রিবিউশন রেখেছেন বিদেশিরা। এদের অনেকের সঙ্গেই ভারতের ট্যুরিজম সেক্টরকে আরও ঘনিষ্ঠভাবে পরিচয় করানোর কাজটি সেরেছেন প্রবাসীরাই। এছাড়াও হেলথ কেয়ার ইউনিট। গোটা বিশ্বে আধুনিক চিকিৎসা যেভাবে আধুনিকতর থেকে আধুনিকতম হচ্ছে, সেটা প্রবাসী ভারতীয়দের মাধ্যমে ভারতের মাটিতে ইন্ট্রোডিউস করানো যেমন খুব সহজ, তেমনই ভারতের চিকিৎসাশাস্ত্রকে পৃথিবীর বুকে ছড়িয়ে দিতেও প্রবাসী ভারতীয়দের ভূমিকা থেকে যায়। অতিমারির সময় বহু প্রবাসী ভারতীয় দেশে তৈরি ভ্যাক্সিন সহ বিভিন্ন চিকিৎসার সরঞ্জাম বিদেশে পৌঁছে দিয়েছেন। এর ফলে গোটা বিশ্বে ভারতের মহানুভবতার ছবিটা আরও স্পষ্ট হয়েছে।
মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ারসের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, বর্তমানে গোটা বিশ্বে এনআরআই-এর সংখ্যা ৩২ মিলিয়ন মতন। সুতরাং সকল প্রবাসী ভারতীয়দের একসঙ্গে করে যদি ভারতের সার্বিক উন্নতির বিষয়টা তুলে ধরা যায়, তাহলে প্রবাসী ভারতীয়দের আগ্রহ তৈরি হবে আরও অনেকটাই বেশি। কারণ, ঐ- ভারতের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর একমাত্র প্রবাসী ভারতীয়রাই। সুতরাং তাঁদের হাত ধরে ভারত বিশ্বদরবারে পৌঁছে যাবে, আর সেটা অলরেডি প্রমাণিত।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ