মুম্বই- এখানে মানুষ আসে স্বপ্নপূরণের জন্য। এখানেই তৈরি হয় একের পর এক বিগ বাজেটের সিনেমা। এখান থেকেই বেড়ে ওঠে কোটি কোটি টাকার প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় অর্থনীতির খুঁটি শক্ত করে এই শহরটাই। এটা এমনই একটি শহর, যে শহর কোনদিন ঘুমোয় না। ইতিহাস যাকে চেনে বোম্বে হিসেবে। একেই বলা হয় ভারতের বাণিজ্য নগরী বা মায়া নগরী। আজ আপনাদের জানাবো, মুম্বই ঠিক কিভাবে নিজেকে বাণিজ্য নগর হিসেবে তৈরি করল। তাহলে আর সময় নষ্ট নয়। চলুন ঘুরে আসি মুম্বই- দ্য গেটওয়ে অফ ট্রেডিং। জেনে নি মুম্বইয়ের কিছু না জানা ইতিহাস।

১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ভারতে ব্রিটিশরা নিজেদের ঘুঁটি সাজাতে শুরু করলেও ব্রিটিশ রাজ চালু হয় ১৮৫৮ থেকে। সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকে রাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে তুলে দেওয়া হয়। ইংরেজদের শাসনকালে ব্যবসা-বাণিজ্যের ঘাঁটি ছিল কিন্তু কলকাতা। সেই সময় ইংল্যান্ড ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কলকাতাকেই চাইত। তারপর গঙ্গার মত আরব সাগরের ওপর দিয়েও বয়ে গেছে সময়। ক্রমশ কমেছে কলকাতার কৌলীন্য। ওদিকে ধীরে ধীরে নিজের আধিপত্য বাড়িয়েছে মুম্বই। কিন্তু কেন মুম্বই হয়ে উঠল দেশের বাণিজ্য নগরী। তার জন্য প্রথমেই বলা যাক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা।

১৮০৬ সালে কলকাতায় জয়েন্ট স্টক ব্যাঙ্কিংয়ের সূচনা ঘটে। আর মুম্বইতে ১৮৪০ সালে চালু হয় স্টক ব্যাঙ্কিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে কলকাতার অর্থনীতিতে ব্যাপক দুর্দশা আসে। কলকাতার চরম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ নেয় মুম্বই। তার জন্য অবশ্য কিছুটা কাজ করেছে মুম্বইয়ের ভৌগলিক অবস্থান। মুম্বই অনেক আগে সাতটি ছোট ছোট দ্বীপ ছিল আরব সাগরের বুকে। সেই দ্বীপগুলিই আজ একসঙ্গে মুম্বই শহরের রূপ নিয়ে গোটা দেশের অর্থনীতিকে টেনে নিয়ে চলেছে। আমরা জানি, একটা সময় ভারতের ব্যবসা বাণিজ্য চলত সিল্ক রুট ধরে। যে কারণে দিল্লির মধ্যেও তখন প্রচুর সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, দিল্লি নিজেই চারপাশে বিভিন্ন রাজ্য দিয়ে ঘেরা। ফলে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত টেনাসিটি সেইসময় দিল্লির ছিল না।

অন্যদিকে সমুদ্রপথে ব্যবসা বাণিজ্য চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের কলকাতায় আসতে হত। সমুদ্র থেকে নদীপথে ৮০ মাইল ভিতরে। ফলে শিপিং খরচই পড়ে যেত অনেকটা। এদিকে মুম্বই সুয়েজ খালের কাছাকাছি অবস্থান করায় ইউরোপ থেকে বহু জাহাজ ভিড় করতে শুরু করে এখানেই। তাছাড়া মুম্বইয়ের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে তিনটি জিনিস। কাপড়, সোনা আর স্টক এক্সচেঞ্জ। পশ্চিমী দেশগুলোর জন্য মুম্বই স্টক এক্সচেঞ্জ আরো বেশি ব্যবসাদারদের কাছে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ ভারতের সবচেয়ে পুরনো স্টক এক্সচেঞ্জ। যে কারণে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট মুম্বইকে অনেকটা গতি দেয়। যা ভারতের অর্থনীতিকে অনেকটাই বুস্ট আপ করে।

এছাড়াও মুম্বইয়ের এই অভূতপূর্ব উত্থানের অন্যতম কারণ ভারতের তাবড় প্রতিষ্ঠানগুলোর হেড কোয়ার্টারস রয়েছে এখানেই। আরবিআই, এসবিআই, টাটা, গোদরেজ, রিলায়েন্স থেকে শুরু করে সরকারি বেসরকারি বহু প্রতিষ্ঠানগুলো মুম্বইকে বেস করেই নিজের ব্যবসাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলেছে। এমনকি ফরচুন গ্লোবাল লিস্টে উঠে আসতে থাকা ৫০০ প্রতিষ্ঠান নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেছে নিয়েছে মুম্বইকে। এছাড়া মুম্বইয়ের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে চলার জন্য বড় ভূমিকা নিয়েছে এই শহরের ট্যুরিজম। একটা তথ্য বলছে, ২০২৬ সালে শুধুমাত্র ট্যুরিজম থেকে মুম্বই শহরে রেভিনিউ জেনারেট হতে পারে ৯ বিলিয়ন ডলার। ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিকে যা অনেকটাই ফুয়েল দেবে।

আর সব শেষে বলিউড। আজ গোটা পৃথিবীর মানুষের কাছেই পরিচিত বলিউড। গোটা পৃথিবীতে আর্ন করার দিক থেকে হলিউডকে কার্যত টেক্কা মারছে বলিউড। একটি বছরে যত সিনেমা তৈরি হয় এখান থেকে তেমন আর গোটা বিশ্বে হয় কিনা সন্দেহ আছে। ভারতের বাৎসরিক আয়ের প্রায় ৪০ শতাংশ কন্ট্রিবিউট করে মুম্বইয়ের বলিপাড়া।

বর্তমানে মুম্বইয়ের নমিনাল জিডিপি ছুঁয়েছে ২৪০ বিলিয়ন ডলার। আর পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি অনুযায়ী মুম্বইয়ের জিডিপি ৪০০ বিলিয়ন ডলার। অটোমোটিভ পার্টস, বিস্কিট, টেক্সটাইল মিল, আইটি, হেলথ কেয়ার, পেন্সিলের মত বহু শিল্প আজ রমরমিয়ে ব্যবসা চালাচ্ছে মুম্বইয়ের বুকে। ৬০৩ বর্গকিলোমিটারের এই শহরটিতে বসবাস করছেন ২ কোটিরও বেশি মানুষ। যাদের অনেকে এই শহরে এসেছেন ভাগ্য বদলের জন্য।

আর ঠিক এটাই হল মুম্বই শহরের বাণিজ্য নগরী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ। একইসঙ্গে কেন একে স্বপ্ননগরীও বলা হয়। তাই কথায় বলে, যে একবার মুম্বইতে এসেছে সে কোনদিনই এই শহর ছেড়ে চলে যেতে পারে না।

বিজনেস প্রাইম নিউজ

জীবন হোক অর্থবহ