Trending
ভারতের বাণিজ্যিক শহর মুম্বই। আর এই মুম্বই-তে রয়েছে এশিয়ার সবথেকে বড় বস্তি, ধারাভি। বস্তি শব্দটা বললেই প্রথমে যে দৃশ্যটার কথা মাথায় আসে, এই বস্তির ছবিটাও সেরকম। গায়ে গায়ে বাড়ি, সরু সরু গলি। ২.১ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ধারাভি বস্তিতে কতজন থাকেন, সংখ্যাটা শুনলে চমকে যাবেন। বলা হয়, ধারাভি বস্তিতে বর্তমানে থাকেন প্রায় ৭-৮ লক্ষ মানুষ। তবে কেউ কেউ বলেন, সংখ্যাটা পৌঁছে যেতে পারে প্রায় ১০ লক্ষে। গিজগিজ করছে মানুষ, উন্নয়নের ছাপ এখানে পড়ে না। তবু ধারাভি বছর বছর ধরে মুম্বই শহরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ধারাভির জনপ্রিয়তা আজ আকাশছোঁয়া। আজ এই ধারাভিকে নিয়েই তৈরি হয়েছে একের পর এক ছবি। বহু পর্যটকরাও আসেন ধারাভি বস্তিকে স্বচক্ষে দেখার জন্য। এখানেই শেষ নয়। ধারাভি বস্তি শিক্ষা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুতেই চমকে দেবে দেশের অন্যান্য এলাকাকে। সবকিছুই যেন বড় চমকপ্রদ। কিন্তু ধারাভি বস্তির ইতিহাস কী?
ব্রিটিশ শাসিত ভারতের কথা। সেই সময় মুম্বই বা তৎকালীন বোম্বে শহরকে বিজনেস হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সমুদ্রের ধারে বন্দর তৈরি করে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি আনাই ছিল ব্রিটিশদের প্রধান লক্ষ্য। শুনলে অবাক হবেন যে, আজ যেখানে ধারাভি বস্তি- সেই সময় এলাকায় ছিল বিশাল বড় জলাশয়। এই জলাশয়ে মাছ ধরতেন গরীব মানুষরা। সেটাই ছিল তাদের রুজিরুটির একমাত্র উপায়। খেয়াল রাখবেন, তৎকালীন সময়ে মানুষে মানুষে জাতিভেদ প্রথা, বর্ণভেদ প্রথার চল ছিল ভালোরকম। তাই বোম্বে শহরে যে সকল গরীব পিছিয়ে পড়া জনজাতি আসত, তারা অন্য কোথাও ঠাঁই পেত না। অগত্যা তাদের থাকার জায়গা বলতে একমাত্র ছিল ধারাভি। জলাশয় থাকার জন্য এলাকাটা ব্রিটিশ সরকারের হেলাফেলার জায়গা ছিল। আর ধীরে ধীরে এখানেই দরিদ্র মানুষের জমায়েত হতে থাকে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এভাবেই তৈরি হয় ধারাভি বস্তি। আজ যেখানে মুম্বই শহরে টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটের ভাড়া ৪০-৫০ হাজার টাকা মতন পড়ে যায়, সেখানে ভাগ্যপরীক্ষার জন্য মুম্বই শহরে আসা মানুষের শেষ ভরসা এই ধারাভি বস্তি। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী, জনি ওয়াকারের মতন অভিনেতারাও জীবনের শুরুর দিকে ধারাভি অঞ্চলেই অনেকদিন থেকেছিলেন। ধারাভি বস্তিকে একেবারে সমূলে উৎখাত করার জন্য বহু প্রোমোটারের নজর ছিল এলাকায়। তারা এখানকার মানুষদের উন্নয়নের কথাও ভেবেছিলেন। কিন্তু ধারাভির মানুষরা সেটা মেনে নিতে পারেন নি। তাঁদের প্রতিবাদেই ধারাভি আজও একইভাবে রয়ে গিয়েছে।
ধারাভিতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছেন হিন্দু এবং মুসলিম ধর্মের মানুষ। ২০১১ সালে এই বস্তির জনগণনা করা হয়। সেখানেই দেখা যায়, এখানে হিন্দি, মারাঠি, গুজরাতি মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এছাড়াও উর্দুভাষী মানুষের সংখ্যাও কম নয়। ওয়েস্টার্ন মুম্বই এবং ইস্টার্ন মুম্বই-এর দুটো রেল লাইন চলে গিয়েছে এই ধারাভি বস্তির মধ্যে দিয়ে। এখানেই বলে রাখি, ধারাভি বস্তি হতে পারে কিন্তু এখানে শিক্ষাকে খুব গুরুত্বের চোখে দেখা হয়। আর যে কারণে ছোট থেকেই স্বাক্ষরতার ছাপ পড়তে থাকে ধারাভি বস্তির প্রত্যেকটি শিশুর মুখে-চোখে। বলা হয়, এখানকার পড়ুয়াদের মধ্যে শিক্ষার যে ছাপ রয়েছে সেটা অন্য রাজ্যকে তাক লাগাবার মতন। একটি তথ্য থেকে জানা গিয়েছে, ধারাভি বস্তিতে স্বাক্ষরতার হার ৭০ শতাংশের বেশি। আর যে কারণে এই বস্তির অর্থনীতি আজ কোন দিক থেকে অলৌকিকতার চেয়ে কম নয়।
ধারাভি বস্তিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বহু ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প। বস্তির প্রত্যেকটি মানুষ এই ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। বলা হয়, এই বস্তিতে প্রায় ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটের সংখ্যা প্রায় ৫০০। ছোট ছোট কারখানার সংখ্যা রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার মতন, যেগুলো রয়েছে একেকটি বাড়িতে। মাটির পাত্র, টেক্সটাইল, চামড়া, জুয়েলারির মত বহু জিনিস এখানে ম্যানুফ্যাকচার করা হয়ে থাকে। প্লাস্টিকের বোতল সহ বহু ধাতব জিনিস যা ফেলে দেওয়া হয়, সেগুলো এখানে চলে আসে রিসাইক্লিং-এর জন্য। বলে রাখি, প্রায় ২.৫ লক্ষ মানুষ যুক্ত থাকে এই রিসাইক্লিং-এর জন্য। জানা গিয়েছে, ধারাভিতে তৈরি সামগ্রী চলে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিদেশেও। শুনলে অবাক হবেন, ইন্ডিয়ান ইকোনমিতে ধারাভি বস্তি যেন অপার বিস্ময় তৈরি করেছে। প্রতি বছর প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ইকোনমিক সাপোর্ট দেশকে দিয়ে থাকে ধারাভি বস্তি। এছাড়া একের পর এক সিনেমা যেমন স্লামডগ মিলিওনেয়ারের মতন বহু সিনেমা তৈরি হয়েছে এই বস্তিকে কেন্দ্র করেই। একইসঙ্গে বহু পর্যটক প্রতি বছর মুম্বই আসেন শুধু ধারাভি বস্তির হালহকিকত দেখার জন্য।
অপরিচ্ছন্ন গলি, সরু সরু রাস্তা। কম আয়তন এলাকায় এতো এতো মানুষের বাস। তবু ধারাভির খ্যাতি এবং ইউএসপি যেন মেটার নয়। তাই ধারাভিকে শুধু বস্তি বললেই ভুল বলা হবে। বরং ইন্ডিয়ান ইকোনমির হিডেন জেম বলা যেতে পারে। আপনারাও কি একমত? দেখেছেন ধারাভি বস্তি নিজের চোখে?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ