Trending
চিন রাশিয়ার বন্ধুত্ব যত গাঢ় হচ্ছে, ততই নাকি বিপদ ঘনিয়ে আসছে ভারতের আকাশে। কটাক্ষ বিশ্বের কূটনীতিমহলের। কয়েকবছর আগে এই কথাটা যতটা প্রাসঙ্গিক ছিল, আজ তার সিকিভাগও নেই। কারণ আজকের ভারত আত্মনির্ভরতার মন্ত্রে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আজকের ভারত অপার সম্ভাবনার আঁতুড়ঘর। বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর দেশগুলোর চোখে চোখ রেখে নিজের দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলাবার ক্ষমতা রাখে আজকের ভারত। আর আজ সেই খুঁটির ভিত আরও মজবুত করলো আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ।
আন্দামান এবং নিকোবর-দ্বীপান্তর। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও যার সিংহভাগ জায়গা আনএক্সপ্লোরড! অথচ আজ এই দ্বীপান্তরেই খোঁজ মিলল ভারতের সোনার ভবিষ্যৎ গড়ার গোপন চাবিকাঠি। অফুরান তেলের ভাণ্ডার যে এর অতলেই লুকিয়ে ছিল। আন্দামান নিকোবরকে নিয়ে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এক সমীক্ষাতেই মিলেছে এই তথ্য। কিন্তু কী অদ্ভুত ভাবুন, এতদিন সেই গুপ্তধন সকলের অগোচরেই থেকে গিয়েছে। কেউ সেই গুপ্তধনের সন্ধানই করেনি। সার্ভে রিপোর্ট বলছে, আন্দামান নিকোবরে এত পরিমাণ খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যা কি না ভারতের আগামী ৭০ বছরের চিন্তা দূর করতে পারে। এত অগাধ সম্পত্তি ভারতের দখলে থাকা সত্ত্বেও কেন এতদিন তাঁকে অবহেলা করা হল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে বরং বলা যাক, হঠাৎ দ্বীপান্তরে সমীক্ষা চালানো হল কীসের ভিত্তিতে?
উত্তরটা খুবই সহজ। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলছে, ভৌগলিক অবস্থানের দিক থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে আন্দামানের বেশ সিমিলারিটি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মতই এখানেও তিনটি টেকটনিক প্লেট অর্থাৎ ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান প্লেট এবং ইউরেশিয়ান প্লেট সাবমার্জ করে এই আন্দামান অঞ্চলেই। যেটা তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের একজিস্টেন্সকে সাপোর্ট করে। আর এই লজিকের ভিত্তিতেই আন্দামান নিকবরে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক সমীক্ষা। যার রিপোর্ট আজ ভারতকে নতুন দিশা দেখাচ্ছে।
এবার আসা যাক কেন পূর্ববর্তী ভারত সরকার এতদিন এই রহস্য ভেদ করার কোন প্রচেষ্টা করেননি? কেন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম এনার্জি কনজিউমিং কান্ট্রি হওয়া সত্ত্বেও ভারতের অয়েল ইমপোর্ট করার রেট বছরের পর বছর শুধু বেড়েই চলল? – সেই প্রসঙ্গে। দেখুন, আন্দামান নিকোবরের এই ন্যাচারাল রিসোর্স যে কারও কাছে অজানা ছিল তেমনটা নয়। আসলে এই এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জনের প্রায় ৪২% মতন এরিয়া নো গো জোনের আন্ডারে ছিল। তবে ইন্ডিয়ান নেভি, কোস্ট গার্ড এবং ডিআরডিও-এর তৎপরতায় এই অঞ্চলের উপর থেকে নো গো জোনের ট্যাগ সরিয়ে রিসার্চ চালানো সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এত রিসার্চ এত তৎপরতা, কোন কাজে আসবে কি? আন্দামানকে নিয়ে কি স্বপ্ন দেখছে ভারত? সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কি?
তথ্য বলছে, প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে আন্দামান নিকোবরের আঞ্চলিক উন্নয়ন নিয়ে একাধিক কাজ করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। দ্বীপপুঞ্জকে ভারতের প্রথম মেরিটাইম হাব বানানোর জন্য ১০০ মিলিয়ন টাকার ইনভেস্টমেন্ট থেকে শুরু করে ট্যুরিজম, কানেঙ্কটিভিটি এবং এনার্জি ডেভলপমেন্ট- সবটাই হয়েছে মাত্র ৫ বছরের মধ্যে। সম্প্রতি আন্দামানের ৭ টি দ্বিপে হাইস্পিড ইন্টারনেট পরিষেবা প্রদানের জন্য চেন্নাই থেকে আন্দামান আন্ডার অয়াটার ইন্টারনেট কেবিল সংযোজনের ঘোষণাও সেরেছে ভারত সরকার। প্রসঙ্গত, আন্দামানের জন্য ৫ হাজার কোটির ডিফেন্স প্ল্যানও ফাইনালাইজ করেছে মোদী সরকার। আর এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে খনিজ তেল সম্পর্কে এমন তথ্য রাতারাতি ঝড় তুলেছে বাণিজ্য মহলে। কাজেই এইবারেও হয়তো এই দ্বীপান্তরের হাত ধরেই কোন এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের সাক্ষী থাকতে পারে ভারত।
কেন আন্দামানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে ভারত? প্রথমেই যেটা আন্দামানের কাছে অ্যাডভান্টেজ, সেটা হচ্ছে আন্দামানের স্ট্র্যটেজিক লোকেশন। যেটা আন্দামানের ইউএসপি। ভারত মহাসাগরে ভারতের সিক্যুরিটি এবং চিনের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিকালি ডিল করতে যেটা ভারতের ব্রহ্মাস্ত্র। উত্তরে মায়ানমার থেকে মাত্র ২২ মাইল আর দক্ষিনে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৯৩ মাইল দূরত্বে অবস্থিত এই আন্দামান নিকবর দ্বীপপুঞ্জ, মালাক্কা প্রণালীর পশ্চিমে অবস্থিত। যেখান দিয়ে প্রতিদিন এই চ্যানেল ধরে প্রায় ৬০ হাজারের বেশি কমার্শিয়াল জাহাজ বাণিজ্য করে। পরিসখ্যান বলছে, এই দ্বীপপুঞ্জ ভারতের ৩০% ওভারল ইকোনমিক জোনের মধ্যে পড়ে। আর যে অঞ্চল অর্থনীতিকে পরোক্ষভাবে এতটা সমৃদ্ধ করে, সেখানে তেলের ভাণ্ডারের খোঁজ কি দারুন মাইলস্টোন- অনুমান করতে পারছেন? কিন্তু এত সম্ভাবনা, এত সমীক্ষা- সবটা পূরণ করার রাস্তা কী এতটাই সহজ?
কখনই না। এক্ষেত্রেও প্রচুর বাধা রয়েছে। যেগুলো প্রায় আনঅ্যাভয়ডেবল। লিস্টের এক নম্বরেই রয়েছে ফিনান্সিয়াল অবস্ট্যাকল। তেল উত্তলনের জন্য প্রাথমিকভাবে চারটি কুয়ো খননের প্ল্যানিং রয়েছে ওএনজিসি-র। কিন্তু এক একটা কুয়ো খননের জন্য খরচ প্রায় ৩০০-৪০০ কোটি টাকা। যে কারণে থার্ড পার্টি ইনভেস্টমেন্টের কথাও বলেছে সংস্থা। রয়েছে এনভায়ারনমেন্টাল চ্যালেঞ্জও। ফ্লরা, ফনা, রেইন ফরেস্ট, সি বিচ, কোরাল আইল্যান্ড- সবটা মিলিয়ে আন্দামান নিকোবর গোটা ভারতের কাছে একটা অ্যাসেট তো বটেই। কাজেই বিশ্বমানচিত্রে ছাপ রাখতে গিয়ে পরিবেশের কোন ক্ষতি না হয়ে যায়, সেই বিষয়টাও মাথায় রাখা জরুরী।
ইন্ডিয়া- দ্য ল্যান্ড অফ ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি। তবে, মানুষের মধ্যে ঐক্য এবং সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য- শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয় ভারত। ভারতের ঐক্য এবং বৈচিত্র্যের সংজ্ঞাটা এর বাইরে আরও অনেককিছু। আজ তাই লিথিয়াম সহ অনান্য খনিজের খোঁজ, প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে তেলের খনি-ন্যাচারাল রিসোর্সের ক্ষেত্রেও ভারত সেই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যকে অক্ষরে অক্ষরে বেঁধেছে। যার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ আন্দামান। এখন শুধুমাত্র অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং অ্যাডভেঞ্চার এক্সপেরিয়েন্স করার পটভূমির নাম আন্দামান নয়। ভারতের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যনগরী হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে সে। ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে এতদিনের আগলে রাখা যখের ধন। যে সম্পদের হাত ধরেই ভবিষ্যতে ওপেক বিশ্বের জগতে মেগা এন্ট্রি নিতে পারে ভারত। তবে, প্রশ্ন হচ্ছে এই অগাধ সম্পদের সঠিক ব্যবহার হবে তো? হলেও, দেশের সাধারণ মানুষ তার সুবিধা উপভোগ করতে পারবেন তো?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ।