Daily
নরমাংস খেতে নাকি তাঁর আপত্তি নেই। করোনাকালে সিনিয়র সিটিজেনদের মৃত্যু তাঁকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচিয়েছিল। এমনই একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে নিজের দেশেই খলনায়ক হয়ে উঠছিলেন তিনি। ব্রাজিলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারো। তাঁর অতি-দক্ষিণপন্থী একনায়কতন্ত্র মনোভাব ব্রাজিলবাসীর জন্য দুর্ভাগ্য বই আর ভালো কিছু টেনে আনছিল না। সুর চড়িয়েছিলেন বিরোধী দলের নেতারাই। ব্রাজিলবাসীরাও নিঃসন্দেহে তিতিবিরক্ত হয়ে উঠছিলেন বোলসোনারোর এই একের পর এক সিদ্ধান্তকে ঘিরে। অবশেষে, ঘুরল চাকা। বোলসোনারোর হাত থেকে ব্রাজিলের দায়িত্ব গেল লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভার হাতে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হলেন লুলা। একইসঙ্গে ব্রাজিলে আবারও ফিরল বাম জমানা। অনেকেই বলছেন, অতি-দক্ষিণপন্থী নেতার হাত থেকে বামপন্থী নেতার হাতে দেশের ভাগ্যকে তুলে দেওয়া, ব্রাজিলের রাজনৈতিক মঞ্চের জন্য নিয়ে এলো এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন।
লুলা দ্য সিলভা। জীবনের শুরুর দিকে তিনি ছিলেন একজন নেহাতই কারখানার শ্রমিক। পরে তাঁর হাত ধরেই প্রতিষ্ঠা পেল ব্রাজিলের ওয়ার্কার্স পার্টি। অবশ্য লুলা যে প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হলেন এমন নয়। কারণ, ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন প্রেসিডেন্টের পদে। কিন্তু ২০১৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক আর্থিক এবং দুর্নীতির অভিযোগ টেনে আনা হয়। বামপ্রার্থীকে পাঠানো হয় জেলে, সাল ২০১৮। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের কারণে ৫৮০ দিন তাঁকে জেল খাটতে হয়। তারপর, গেল বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় অভিযোগ নাকচ করে দেয় শীর্ষ আদালত। তারপর থেকেই ওয়ার্কার্স পার্টির প্রতিষ্ঠাতা লুলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বোলসোনারোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে জানা যায়। লুলার এই ঘোষণার পরেই যে ব্রাজিলের পলিটিক্যাল সিনারিও পাল্টাতে চলেছে, তা স্বীকার করে নিয়েছিলেন সেই দেশের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। হলও তাই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লুলার পেলেন ৫১% ভোট। অন্যদিকে বোলসোনারো পেয়েছেন ৪৯%। এবার আসা যাক বোলসোনারোর বিরুদ্ধে ঠিক কি কি অভিযোগ উঠেছিল।
প্রথম, করোনাকালে বোলসোনারোর চরম গাফিলতি মৃত্যুমিছিল ডেকে আনে ব্রাজিলে
স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে তাঁর উদাসিনতা ছত্রে ছত্রে পরিষ্কার হচ্ছিল। একদিকে দেখা গেছিল মৃত্যুমিছিল। প্রায় ৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ব্রাজিলে। তারপরেও তাঁর নির্বিকার মনোভাব বোলসোনারোকে নিজের দেশেই ভিলেন করে তোলে। অন্যদিকে তিনি সিনিয়র সিটিজেনদের মৃত্যু নিয়ে একেবারেই সহমর্মী ছিলেন না। তিনি মনে করতেন, বয়স্কদের মৃত্যু হলে পেনশনের টাকা খরচ করার প্রয়োজন পড়বে না। অর্থাৎ, আর্থিক সাশ্রয় হবে ব্রাজিলের।
দ্বিতীয়, নির্মমভাবে অ্যামাজনের জঙ্গল সাফ
বোলসোনারোর সময় জঙ্গল সাফের মতন অপরাধ খুব তাড়াতাড়ি হচ্ছিল। অনেকেই সেই সময় অভিযোগ তুলেছিলেন, শিল্পপতিদের সুবিধে করে দেবার জন্যই নির্মমভাবে অ্যামাজনের জঙ্গল সাফ করছেন তিনি।
তৃতীয়, আপত্তি নেই নরমাংসে
বোলসোনারো বলেছিলেন, অ্যামাজনের জঙ্গলে একবার ইয়ানোমামি অঞ্চলে তিনি গিয়েছিলেন। সেখানকার রীতি, কয়েকদিন ধরে নরমাংস রান্না করে সেটা কলা দিয়ে খাওয়া হয়। তাঁর সতীর্থরা আপত্তি জানালেও, নরমাংস খেতে আপত্তি ছিল না তাঁর। পরে অবশ্য জানা যায়, ঐ উপজাতির মধ্যে নরমাংস খাবার কোন প্রচলন নেই।
চতুর্থ, প্রাইভেটাইজেশন
ইয়ে…মানে, অন্যভাবে নেবেন না। আসলে, বেসরকারিকরণের মনোভাব ব্রাজিলের মানুষ খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। তার মধ্যে পেট্রোবাস এবং সেই দেশের পোস্টাল সার্ভিসকে বেসরকারিকরণের ডাক দিয়েছিলেন ব্রাজিলের প্রাক্তন একচ্ছত্র অধিপতি।
এগুলো ছাড়াও আরও অন্যান্য অভিযোগ ছিল প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোর বিরুদ্ধে। এমনকি তাঁর প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায় গলায় বন্ধু ছিলেন তিনি। সেটাও ওয়ার্ল্ড পলিটিক্সে তাঁর ব্যাড বয়ের ইমেজ তুলে ধরে। যে কারণে ব্রাজিলের সাধারণ মানুষ তাঁকে গদিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত নেয়। এবং সেটাই প্রমাণ করে দিল, ফ্যাসিজমের জমানা শেষ। ৭৭ বছর বয়সে কামব্যাক করল ব্রাজিল। লুলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হবার পর, প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ব্রাজিলে শান্তি এবং একতাই ফিরিয়ে আনবেন। তার সঙ্গে লক্ষ্য রাখবেন অ্যামাজনের স্বাস্থ্যের দিকে। স্বাভাবিকভাবেই বামপন্থী লুলার জয় যেমন একদিকে প্রতিষ্ঠা করল নতুন ভোরের, তেমনই উঠে এলো অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতি থেকে স্বাস্থ্য। স্বাস্থ্য থেকে পরিবেশ। এই সবই আবার নতুন করে লেখা শুরু হবে লুলার হাত ধরেই। আর যে কারণেই লুলা নির্বাচনে জয়ের পর বললেন, ‘ব্রাজিল ইজ ব্যাক’।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ