Story
ভারতীয় কৃষি অর্থনীতিতে যুগান্তকারী চাষ হল লেমনগ্রাস। যাকে গোটা ভারত নিম্বুঘাস নামেই চেনে। নিম্বুঘাসের চাষ এতটাই সহজ যে আজ অনেক ভারতীয় কৃষকরা প্রচলিত চাষ ছেড়ে এই নিম্বুঘাস চাষ করে চলেছেন নিজেদের জমিতে।
খুব কম খরচে সামান্য জৈব সার ব্যবহার করে অপেক্ষাকৃত কম অনুর্বর জমিতেও এই ঘাস চাষ করা সম্ভব। সমতল কিংবা মালভূমি। জমির চরিত্র যেখানে যাই হোক না কেন, এমনকি পাহাড়ের রুক্ষ মাটিতেও এই লেমনগ্রাস চাষ আজ অনেকটাই সহজ হয়ে গিয়েছে। লেমনগ্রাস এমনই একটি ফসল যা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে আজ ভারতের রফতানি বাণিজ্যে বেশ অংশ জুড়ে রয়েছে লেমনগ্রাস।
লেমনগ্রাসের বৈজ্ঞানিক নাম হল- সিম্বোপুগোন। এর পঞ্চাশ রকম প্রজাতি থাকলেও বর্তমানে অর্থকরী লাভজনক ফসল হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে সিম্বোপুগোন সিট্রাস। মূলত আমেরিকা মহাদেশ, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, চিন, ভারত ছাড়াও এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন ক্রান্তীয় দেশগুলিতে আজকাল লেমনগ্রাস চাষ খুবই জনপ্রিয় হয়েছে।
ভারতের সুগন্ধি শস্য হিসেবে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিশেষ করে কেরালা এবং মহারাষ্ট্রে এই চাষ খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও তামিলনাড়ু, উত্তরপ্রদেশ, অসম, কর্ণাটক, অরুণাচল প্রদেশ, সিকিম এমনকি এই বাংলার উত্তর ২৪ পরগনা সহ বিভিন্ন জেলাতে ক্রমশ জনপ্রিয়তা লাভ করছে লেমনগ্রাস চাষ।
ভারত ২০২০-২১ অর্থবর্ষে লেমনগ্রাসের তেল বিশ্বের ৭৬টি দেশে রফতানি করে আয় করেছে বেশ বিরাট পরিমাণ অঙ্ক। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবর্ষে ভারত ৪ লক্ষ ১০ হাজার ৬৩০ মেট্রিক টন লেমনগ্রাস তেল রফতানি করে আয় করে ৭.২২ মিলিয়ন ডলার। বাণিজ্যের এই অঙ্কটাই বলে দিচ্ছে, নতুন ভারতে নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে উঠে আসছে এই লেমনগ্রাস।
বিশ্বজুড়ে লেমনগ্রাস চাষের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পিছনে রয়েছে এর ওষধি গুণ এবং অবশ্যই বাণিজ্যিক দিকটি। বিশেষ করে ফার্মা ইন্ডাস্ট্রির পাশাপাশি কসমেটিক ইন্ডাস্ট্রি ও হোটেল ইন্ডাস্ট্রিতেও এই লেমনগ্রাস অয়েল বিভিন্ন কন্টিনেন্টাল ডিস বানাতে অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি রয়েছে জোগানের তুলনায় অপরিসীম চাহিদা। তাই লেমনগ্রাসের দামটাও অনেকটা বেশি। এক কেজি লেমনগ্রাস ভারতীয় বাজারে বিক্রি হয় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কিলো দরে।
কোন একজন কৃষক যদি এক একর জমিতে লেমনগ্রাস চাষ করেন তাহলে তিনি সেই জমি থেকে খরচ খরচা বাদ দিয়েও বছরে এক থেকে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয় করেন। একবার চারা লাগালেই হল। সেই চারা থেকে বিরামহীনভাবে সামান্য সার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করে কৃষক ছয় থেকে সাত বছর পর্যন্ত এই আয় করতে পারেন। আর লেমনগ্রাসের তেল বিক্রি হয় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা প্রতি কেজি।
বর্তমানে এই ঘাসের থেকে জীবনদায়ী ওষুধ তৈরি হয়। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডাইজেস্টিভ ডিসঅর্ডার, বমি, সাধারণ সর্দিকাশি থেকে আর্থারাইটিসে বিভিন্ন ধরণের ওষুধ পর্যন্ত তৈরি হয়ে থাকে। এই ঘাস প্রথম পাওয়া যায় ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চিন, গুয়াতেমালা, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়াতে। অতি সহজেই বাড়ির ব্যালকনি কিংবা ছাদেও এই ফসল চাষ করা সম্ভব টবে রেখে। শুধু তাই নয়। এমনকি মশা মারতে এবং সাপ তাড়াতেও লেমনগ্রাসের জুড়ি মেলা ভার। তাই যারা বাড়িতে কেমিক্যাল মসকুইটো কিলার ব্যবহার করতে চান না। তাঁরা সহজেই এই লেমনগ্রাস তেল ব্যবহার করতে পারেন মশা তাড়ানোর জন্য। চিকিৎসকের পরামর্শ মত লেমনগ্রাসের চা আপনাকে একশো শতাংশ রিফ্রেশ করবে এ কথা বলাই যায়।
অভাগীর স্বর্গে গফুর চাষিদের দিন এখন শেষ। কৃষিদফতর বা ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পরিষদে কৃষকরা খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন এই ফসল চাষের বিস্তারিত তথ্য। চিরাচরিত চাষের পরিবর্তে ভারতীয় কৃষিতে আক্ষরিক অর্থে নতুন ভারতে ক্রমশ নিজের জায়গাটা পোক্ত করে নিচ্ছে লেমনগ্রাস।
ঋতিঙ্কর বসু