Market
আজকের দিনে এক ডলারের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ৭৮ টাকার কিছু বেশি। এক ইউরোর নিরিখে ৮২ টাকার আশেপাশে। পাউন্ডের ক্ষেত্রে ৯৫ টাকার মতন। কিন্তু আপনি শুনলে অবাক হবেন যে, এই সবকিছুকে ছাপিয়ে পৃথিবীর অন্যতম এক্সপেনসিভ কারেন্সির জায়গা দখল করে নিয়েছে অন্য একটি মুদ্রা। যার নাম কুয়েতি দিনার। ১ কুয়েতি দিনার ভারতীয় টাকায় প্রায় ২৫৫ টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কী এমন বিশেষত্ব রয়েছে এই কুয়েতি দিনারে? যার জন্য এই কারেন্সি ডলার, ইউরো বা পাউন্ডকে হারিয়ে এতটাই এক্সপেনসিভ হয়ে উঠেছে? আসুন, আজ বলব সেই প্রতিবেদন।
কুয়েতি দিনারের ব্যপারে কথা বলতে গেলে আগে আমাদের কুয়েতের ইতিহাস একটু জেনে নিতে হবে। আপনি শুনলে অবাক হবেন যে আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে কুয়েতে যে কারেন্সির প্রচলন ছিল সেটা ভারত সরকার দ্বারা ইস্যু করা হত। ঠিকই বলছি। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া কুয়েতের কারেন্সি তৈরি করত। যার নাম ছিল গালফ রুপি। ইন্ডিয়ান রুপি এবং গালফ রুপি প্রায় কাছাকাছি দেখতে হলেও এদের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা তফাত ছিল। সেটা হল নম্বরে। গালফ রুপির যে নম্বর থাকত তা শুরু হত ‘জেড’ দিয়ে। এই গালফ রুপির বিশেষত্ব ছিল যে এই নোট ভারতের মধ্যে ব্যবহার করা যেত না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কুয়েতের মোট দেশের কি এমন প্রয়োজন পড়ল ভারত সরকারের ইস্যু করা কারেন্সিকে ব্যবহার করতে হয়েছিল?
১৭৬৩ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত পার্সিয়ান গালফ এরিয়ায় নিজেদের প্রভাব ছড়িয়েছিল ব্রিটিশরা। যেখানে অবস্থিত এই কুয়েত। কুয়েতের মতন ছোট দেশে ব্রিটিশরা আলাদা করে কোন কারেন্সি তৈরি করতে চায়নি। আর যে কারণে তাদের মনে হল, ভারতে যে কারেন্সি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটা এই দেশে ব্যবহার করাটা অনেক বেশি সহজসাধ্য হবে। এরপর ১৯৪৭ সালে যখন ভারত স্বাধীন হল, তখন কুয়েতকে এই কারেন্সি ব্যবহারের পারমিশন দিল ভারত সরকার। সেই সময় কিন্তু কুয়েতে অয়েল বুম সেভাবে হয়ই নি। কিন্তু সমস্যা তৈরি হল ভারতের, সেটা গোল্ড ট্রাফিকিং। গালফ এরিয়া থেকে প্রচুর সোনা অবৈধভাবে পাচার করা শুরু হয় ভারতে। আর ভারতীয় টাকা বাইরে নিয়ে গিয়ে ফরেন কারেন্সির সঙ্গে এক্সচেঞ্জ করিয়ে দিত। ফলে ভারতীয় অর্থনীতিতে সেটা বেশ অ্যালারমিং হয়ে ওঠে। আর যে কারণে ১৯৫৯ সালে ভারত সরকার আলাদা কারেন্সি চালুর কথা ঘোষণা করে। আর তাই চালু হল গালফ রুপি। এরপর ১৯৬১ সালে কুয়েত ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পেল। এবং প্রথম আরব কান্ট্রি হিসেবে নিজেদের পার্লামেন্টারি ইলেকশন করল এবং সংবিধান রচনা করল।
১৯৬০ সালে কুয়েত তাদের নতুন কারেন্সি নিয়ে আসে- কুয়েতি দিনার। সেই সময় ১ কুয়েতি দিনার ছিল ১৩.৩৩ টাকার সমান। এদিকে ভারতকে চিন, পাকিস্তানের মত দেশগুলোর সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণে ভারত সরকার ইন্ডিয়ান কারেনসিকে ডিভ্যালু করে দেয়। যা গালফ দেশগুলোর ওপর ভালোরকম প্রভাব ফেলে। ১৯৭৫ সালে কুয়েতি দিনারের এক্সচেঞ্জ রেট ফিক্স করে দেওয়া হল। আজকের দিনে পৃথিবীর অধিকাংশ কারেন্সি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ কারেন্সি বা মিক্সড এক্সচেঞ্জ রেটের উপর হয়। আরবের দেশগুলো ছাড়া। কুয়েতি দিনার কোন নির্দিষ্ট কারেন্সির সঙ্গে ফিক্সড নয়। বরং ডলার, পাউন্ডের মত একাধিক বাস্কেট অফ কারেন্সির সঙ্গে এর ভ্যালু জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এভাবে মেনটেন করার জন্য প্রয়োজন যথেষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সঞ্চয় করে রাখা। আর আরবিয়ান কান্ট্রিতে অর্থনীতি শক্তিশালি রাখে তেল। যেহেতু ১৯৫০ সাল থেকে তেলের দর বিশ্ব বাজারে ওঠানামা করছে, সেই কারণে ফিক্সড এক্সচেঞ্জ রেট সিস্টেমে চলছে এই কুয়েত, কাতারের মত দেশগুলো। আর তাই তো এই দেশগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণ ডলার রিজার্ভ করা আছে। কুয়েতের কাছে পৃথিবীর সবথেকে বড় অয়েল রিজার্ভার রয়েছে। আর যে কারণে কুয়েত হাই ভ্যালু পেগ মেনটেন করে চলেছে। এবার বলি ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট। কুয়েতের ভেতরে যত টাকা আসছে ফরেন ইনভেস্টমেন্ট বা এক্সপোর্ট থেকে, তার চেয়ে অনেক বেশি কুয়েতি দিনার যাচ্ছে বাইরে। ফলে বিশ্ব বাজারে চাহিদা তৈরি হচ্ছে আরও। বাড়ছে ভ্যালু। আর এভাবেই কুয়েতি দিনার বিশ্ব বাজারে ক্রমশ শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে উঠে এলো। এটাও ঠিক যে কুয়েতের ভাগ্যেও চলেছে ইকোনমিক ক্রাইসিস। অতিমারির ধাক্কা, তেলের ওঠাপড়া এই সবই রয়েছে এই ক্ষয়ের জন্য। কুয়েতে কাউকে ট্যাক্স দিতে হয়না। কুয়েত নিজের শহরবাসীর জন্য প্রচুর টাকা খরচ করে। ফ্রি হেলথ কেয়ার, ফ্রি এডুকেশন, চিপ ইলেক্ট্রিসিটির মত বহু সাবসিডিজ দেওয়া হয়। তাই এখন তারাও শুধু তেলের ওপরেই নির্ভরশীল থাকতে চাইছে না। বিভিন্ন খাত থেকে আয়ের রাস্তা তারা খুঁজে চলেছে।