Trending
সত্যিই কি বড় ব্লান্ডার করেছিলেন দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু? অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের শাহি গর্জন সেদিকেই তো ইঙ্গিত দিচ্ছে। জম্মু কাশ্মীর থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে ঐতিহাসিক বলছেন। একইসঙ্গে কংগ্রেস নেতা এবং সাংসদদের উদ্দ্যেশ্যে অমিত শাহ বারবার আক্রমণ করে চলেছেন জওহরলাল নেহেরুকে। দিনের শেষে জম্মু-কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ সুপ্রিম কোর্ট তো বিচার করেই দিলেন। কিন্তু রাজনীতির মঞ্চে এটাই যেন মোদী ভার্সেস নেহেরুর লড়াই হয়ে গেল। মানে প্রথম প্রধানমন্ত্রী ভার্সেস বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি সরকার কেন নেহেরুকে কাঠগড়ায় তুলছে? কেন বলা হচ্ছে এই রায় ঐতিহাসিক আর রাজ্যের মর্যাদা ফিরে পেয়ে কি আদৌ খুশি হবেন জম্মু-কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ? চলুন, এই বিষয়গুলো নিয়েই একটু আলোচনা সাড়া যাক।
প্রথমেই বলি, সংবিধানের যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার কড়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা একেবারেই অসাংবিধানিক নয়। এই মর্মে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ এই রায় দেন সোমবার। পাঁচ বিচারপতি হলেনঃ বিচারপতি সঞ্জয় কিসান কল, বিচারপতি সঞ্জীব খান্না, বিচারপতি বিআর গাভাই এবং বিচারপতি সূর্য কান্ত। তাঁরা জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তারপর সেখানে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। এরপর ২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের যে সিদ্ধান্ত নেয় সেখানে সরকারের কোন ভুল ছিল না। কেন তাঁদের এমন মনে হল? তাঁরা বলছেন, ৩৭০ অনুচ্ছেদ আসলে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা। যা কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। এবং এই ৩৭০ ধারাটি সাময়িকভাবে প্রয়োগ করা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, জম্মু এবং কাশ্মীর যেদিন থেকে ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, সেই দিন থেকেই ঐ রাজ্য ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফলে জম্মু-কাশ্মীরের আলাদা কোন সার্বভৌমত্ব নেই। আদালত জানায়, ৩৭০ ধারা প্রয়োগ করা হয় কারণ, দেশের অন্যান্য রাজ্যর সঙ্গে যাতে জম্মু-কাশ্মীর সমান জায়গায় চলে আসে। বিচারপতি কল আবার সাফ জানিয়ে বলেছেন যে, শত্রুর বিরুদ্ধে সেনা লড়াই করবে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা তাঁরা সামলাবেন না। কাশ্মীরে সেনা প্রবেশ করার জন্য সবথেকে বেশি কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে সেখানকার স্থানীয় বাসিন্দাদের। বিচারপতির বেঞ্চ থেকে এটাও বলা হয় যে, ৩৭০ ধারা প্রয়োগ আসলে সামঞ্জস্যহীন ফেডেরালিজমের এগজাম্পল ছিল। এই অনুচ্ছেদ বাতিল হবার পর ফেডেরালিজমে কোন আঁচড় পড়ে নি।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় আসার পর অ-বিজেপি দলগুলো মোটেই খুশি নন। স্পেশ্যালি কাশ্মীরে যে দলগুলো বিজেপি বিরোধী। যেমন এনসি নেতা ওমর আব্দুল্লাহ জানিয়েছেন, তিনি হতাশ ঠিকই তবে আশাহত এখনই হননি। আবার ওদিকে প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা গুলাম নবি আজাদ সুপ্রিম কোর্টের রায়কে দুর্ভাগ্যজনক বলছেন। কিন্তু সত্যিটা কী? সত্যিই কি সুপ্রিম কোর্টের রায়ে খুশি নন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ? দেখুন, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে জম্মু-কাশ্মীরে ভোট করাবার নির্দেশ ইলেকশন কমিশনকে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। কারণ এখন তারা রাজ্য মর্যাদা ফিরে পাচ্ছে। কিন্তু জম্মু-কাশ্মীরের মানুষ নাকি সুপ্রিম কোর্টের এই রায় নিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন না। কেন? অনেকেই মনে করছেন যে ৩৭০ ধারা ছিল তাঁদের ক্ষমতায়নের একটা অস্ত্র। যেখানে একটা সময় কর্ম সংস্থান থেকে জমি কেনা, বাড়ি নির্মাণ এই সবই এলাকার মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এখন আর সেটা থাকল না। কারণ অনেকের মতে এই অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করা হল বলে এখন আর জম্মু-কাশ্মীরের বাসিন্দাদের চাকরি বা জমি সুরক্ষার কিছু রইল না। হারিয়ে গেল সকল সুরক্ষাকবচ। সেখানকার আইনজীবীদের মতে, এই বিশেষ মর্যাদা লোপ পাবার পর নাকি বহু কাশ্মীরিকে আটক করা হয় যাদের মধ্যে অনেকেরই আর খোঁজ মেলেনি। এমনকি ১৯৮০ সালে যে সত্যানুসন্ধানী কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার অন্যতম লক্ষ্য ছিল কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ফিরিয়ে আনা। কিন্তু হয়েছে নাকি উল্টো। কাশ্মীরের রাজ্য মানবাধিকার কমিশন বন্ধ হবার কারণে হাজার হাজার অভিযোগের কোন ফয়সালা হয় নি। কোন কিছুর তোয়াক্কা না করেই বাহিনী বেআইনি ধরপাকড় চালিয়েছে। বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে বহু এলাকাবাসীর। তবে সবথেকে অদ্ভুত ব্যপার কি জানেন? জম্মু-কাশ্মীরের রাজা হরি সিং-এর ছেলে এবং কংগ্রেস নেতা মনে করছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় মেনে নিয়েই বরং আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করা যাক। অনেকের ধারণা, জম্মুতে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে সেখান থেকেই মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন করতে পারবে বিজেপি। আপাতত সেটাই হতে চলেছে তাদের বড় পরিকল্পনা।
আর এসবের মধ্যেই নতুন করে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে দিয়েছে। তাহলে কি সুপ্রিম রায় আদতে কাশ্মীরবাসীর পক্ষে গেল না? খুব কি প্রয়োজন ছিল জম্মু-কাশ্মীর নিয়ে এভাবে কাটাছেঁড়া করার? অমিত শাহ অবশ্য মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদীর সিদ্ধান্ত একেবারে সঠিক। কারণ নেহেরু দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলেও তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আদতে সেটা ছিল খুব বড় ভুল। নেহেরু কি ভুল করেছিলেন? অমিত শাহের বক্তব্য তেমনই ইঙ্গিত দিচ্ছে। তিনি মনে করেন, নেহেরু সেই সময় এই বিশেষ মর্যাদাকে অস্থায়ী বলেছিলেন। তিনি যদি মনে করতেন তাহলে জরুরি ধারা হিসেবে তাকে চিরস্থায়ী করে রাখতে পারতেন। অমিত শাহের বক্তব্য, নেহেরুর ঐ একটি পদক্ষেপ আসলে সন্ত্রাসবাদের মত সমস্যাকেই আরও গভীর করে তুলেছে। অমিত শাহ-এর বক্তব্য জুনাগড়, হায়দ্রাবাদ, লাক্ষাদ্বীপ এবং যোধপুরের মত এলাকাগুলোকে সংযুক্তিকরণের সময় কোন সমস্যা সৃষ্টি হয় নি। কারণ সেখানে ছিলেন বল্লভভাই পাটেল। যত সমস্যা তৈরি হয়েছে কাশ্মীরকে ঘিরেই। আর এই কাশ্মীরের দায়িত্বে ছিলেন নেহেরু। আর নেহেরুর জন্যই নাকি কাশ্মীরে সেনা পাঠানোয় অনেকটা দেরি হয়ে যায়। ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের সংযুক্তিকরণ দেরি হয় আর বিশেষ পদ পান শেখ আবদুল্লাহ। স্বাভাবিকভাবেই জম্মু-কাশ্মীরের যাবতীয় দোষ যদি শুধু নেহেরুর ওপর বর্তায় তখন সেটা কংগ্রেসের জন্য অত্যন্ত গায়ে লাগার মত পরিস্থিতি। ফলে লোকসভার মত রাজ্যসভাতেও কংগ্রেস সাংসদরা ওয়াক আউট করেন। তবে অধীর রঞ্জন চৌধুরী, পি চিদম্বরমের মত বর্ষীয়ান কংগ্রেসিয়ানরা সুপ্রিম কোর্টের রায়কে নমো নমো করে মেনে নিলেও এখন তাঁরা দ্রুত চাইছেন যাতে সেখানে নির্বাচন করানো যায়। যাই হোক, সব মিলিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠে গেল দেশের রাজনীতির মঞ্চে। তার মধ্যে সবার প্রথম এই অনুচ্ছেদ তুলে নেবার কারণে কি জম্মু-কাশ্মীরবাসী আদৌ সকল সুবিধে থেকে বঞ্চিত হবেন? দিনের শেষে কি বিষয়টা নেহেরু ভার্সেস মোদী হয়ে উঠল না? মতামত জানান কমেন্ট বক্সে। সঙ্গে লাইক শেয়ার মাস্ট। আর নতুন হলে ভুলবেন না সাবস্ক্রাইব করতে বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ