Trending
বদলাতে চলেছে ভারতের ভাগ্য? টেক্কা দেবে এবার চিনকে? আর ভারতের এই ভাগ্য পরিবর্তন জোরদার করতে চলেছে জম্মু-কাশ্মীর। কারণ- টন টন লিথিয়ামের ভাণ্ডার। শিলমোহর দিয়েছে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া। তারপরেই তোলপাড় শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। আহা, শুধু দেশ বলে নয়, বিদেশেও পড়েছে হইচই। কারণ লিথিয়ামের বাজারে এবার ছড়ি ঘোরানোর দিন এসেছে ভারতের। ভবিষ্যতে গাড়ি প্রযুক্তিতে যে পরিবর্তন আসতে চলেছে, সেই পরিবর্তন আনার জন্য আসল চাবি হচ্ছে লিথিয়াম। আর সেটাই এসেছে ভারতের হাতে। সুতরাং, আগামী কয়েক বছরে লিথিয়ামের দরুনই ভারত দাদাগিরি দেখাবে বিশ্ব বাজারে। মোদ্দা কথা জম্মু-কাশ্মীরে খুঁজে পাওয়া লিথিয়াম জ্যাকপট হতে চলেছে ভারতের জন্য। কিন্তু লিথিয়াম খুঁজে পেলাম আর তারপরই গ্লোবাল মার্কেট রুল করতে বসে গেলাম, বিষয়টা কি এতটাই সহজ? একেবারেই না। কারণ লিথিয়াম পেলেই হল না। সেখান থেকে ব্যাটারি তৈরি করার জন্য যে প্রসেস রয়েছে, সেটা জম্মু-কাশ্মীর এলাকা হবার কারণে একটু সমস্যা তৈরি করতে পারে।
প্রথমেই বলি, গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি লিথিয়াম মজুদ রয়েছে বলিভিয়ায়। সেখানে লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেছে ২১ মিলিয়ন টন মতন। এছাড়া আর্জেন্টিনা এবং চিলিতেও ভালোরকম লিথিয়ামের ভাণ্ডার রয়েছে। এমনকি আমেরিকাতেও লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেছে ভালোরকম। এছাড়া রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সেখানেও ৭৯ লক্ষ টন লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেছে। ভারতে এতদিন পর্যন্ত সেভাবে লিথিয়ামের কোন খোঁজ না-পাওয়ার কারণে এই দেশগুলোর উপরেই ভরসা করতে হত ভারতকে। আর সত্যি বলতে কি, লিথিয়াম ধাতু দিয়ে ব্যাটারি তৈরি করার যে এই প্রসেস এবং তার যে এই বিশাল গ্লোবাল মার্কেট রয়েছে, সেটার অধিকাংশটাই দখল করে রয়েছে চিন। কিভাবে? আমরা সকলেই জানি যে, লিথিয়াম ভবিষ্যতের বাজার ভাগ্যকে দিশা দেখাতে চলেছে। আমরা সকলেই জানি লিথিয়াম এমন একটা কম্পোনেন্ট, যা বিভিন্ন ধরণের ইলেকট্রনিক গ্যাজেটের ব্যাটারি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেটা মোবাইল, ল্যাপটপের মত যা কিছু হতে পারে। কিন্তু এখন লিথিয়াম তো শুধু এই সকল ইলেকট্রনিক গ্যাজেটে ব্যবহার করা হয় না। লিথিয়াম ব্যাটারি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ইভি-তে। যে ইভি হতে চলেছে ভবিষ্যৎ। আর সেই ইভির জন্য লিথিয়াম ব্যাটারির কোন রিপ্লেসমেন্ট নেই। প্রতিদিনই ইভির সংখ্যা নিত্যদিন বাড়ছে। তাই প্রয়োজন বাড়ছে লিথিয়াম ব্যাটারির। আর সেই ব্যাটারি মার্কেটের অধিকাংশ বাজারই দখল করে রেখেছে চিন। এমনকি টেসলা যেসকল ইলেকট্রিক ভেহিকল তৈরি করছে, সেই সকল গাড়ির ব্যাটারি সাপ্লাই হচ্ছে চিন থেকে। জানা গিয়েছে, চিনের একটি কোম্পানি ক্যাটল এই ইভি মার্কেটের ৩৪% দখল করে বসে আছে। এখন বিষয়টা হচ্ছে, যদি সত্যিই লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরির বিষয়টা ভারত করতে পারে, তাহলে কিন্তু আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের ইকোনমি রকেটের গতিতে ছুটতে শুরু করবে। কিন্তু তার আগে বলা যাক, লিথিয়াম ব্যাটারির কাজটা ঠিক কিরকম।
লিথিয়াম হল অত্যন্ত হাল্কা একটি এলিমেন্ট। অ্যালকালি মেটাল গ্রুপের হওয়ার কারণে লিথিয়াম খুব ভালো রিঅ্যাক্টিভ একটি ধাতু। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মধ্যে চারটে কম্পোনেন্ট থাকে। ক্যাথোড, অ্যানোড, সেপারেটর এবং ইলেক্ট্রোলাইট। অ্যানোড হচ্ছে ব্যাটারির নেগেটিভ সাইড এবং ক্যাথোড হচ্ছে ব্যাটারির পজিটিভ সাইড। লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারিতে ইলেকট্রন অ্যানোড থেকে ক্যাথোডের দিকে যেতে থাকে এবং সেখানেই জমা হয়। এই জমা হওয়া ইলেকট্রন এনার্জি তৈরি করে। সেই এনার্জি ব্যবহার করা হয় ল্যাপটপ, ফোনের ব্যাটারিতে। ইলেকট্রোলাইডের মাধ্যমেই ইলেকট্রন নেগেটিভ থেকে পজিটিভের দিকে যায়। আর সেপারেটর শুধু অ্যানোড এবং ক্যাথোডকে আলাদা রাখতে সাহায্য করে। কারণ এই দুটো যদি একসঙ্গে চলে আসে, তাহলে ব্যাটারি শর্ট সার্কিট হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তার হাত থেকেই ব্যাটারিকে রক্ষা করে এই সেপারেটর। এবার বিষয়টা হচ্ছে, শুধু লিথিয়াম হলেই যে কাজ শেষ এমন নয়। কারণ অ্যানোডের জন্য লিথিয়ামের সঙ্গে প্রয়োজন গ্রাফাইট। এবং ক্যাথোডের জন্য লিথিয়ামের সঙ্গে প্রয়োজন নিকেল বা কোবোল্ট। কিন্তু খেয়াল রাখার মত বিষয় যেটা সেটা হল যে এই গোটা ব্যাটারি তৈরি করার জন্য যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, সেটার একমাত্র কারণ ইভি। লিথিয়াম হাল্কা হবার কারণে ব্যাটারি হাল্কা হয়। ব্যাটারি হাল্কা হলে গাড়ির ওজন হাল্কা হবে। আর গাড়ির ওজন হাল্কা হলে মাইলেজ পাওয়া যাবে অনেকটাই বেশি। মনে করা হচ্ছে, ভবিষ্যৎ যেদিকে এগোচ্ছে, তাতে করে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির ডিম্যান্ড বাড়বে ৭ গুণ মতন। এবার আসা যাক ভারতের কথায়।
সাল ১৯৯৭। জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার একটি রিপোর্ট পাবলিশ করা হয়। সেখানে বলা হয় জম্মু-কাশ্মীরে নাকি লিথিয়ামের খোঁজ পাওয়া গেলেও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা আলোচনা স্তরেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর পেরিয়ে গেল ২৫টা বছর। ২০২১ সালে ১৬০০ টন লিথিয়াম খোঁজ পাওয়া গেছিল কর্ণাটকে। কিন্তু পরিমাণটা ছিল নেহাতই কম। অগত্যা বসে না থেকে জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া লিথিয়ামের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছিল। আর অবশেষে এলো সেই দিন। গত ৯ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের সালাল-হাইমানা এলাকায় পাওয়া গেল ৫.৯ মিলিয়ন টন লিথিয়াম বা ৫৯ লক্ষ টন লিথিয়াম। এই পরিমাণ এতটাই যে, ভারতকে এখন লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরি করার জন্য আর চিন বা অন্য দেশের ওপর নির্ভর করতে হবে না। কারণ, এই ভাণ্ডার থেকে লিথিয়াম তুলে এতো পরিমাণ ব্যাটারি তৈরি করা সম্ভব যে শুধু নিজের দেশে ইভি ম্যানুফ্যাকচারিং হিসেবেই নয়। বরং অন্যান্য দেশেও প্রচুর পরিমাণে এক্সপোর্ট করবে ভারত। একটা রিপোর্ট বলছে, ২০২০ সালে যেখানে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারির মার্কেট ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলারের একটু বেশি, সেটাই ২০২৫ সালে পৌঁছে যাবে প্রায় ৯৫ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু এই জ্যাকপট পাবার পরেও যে ছোট একটা সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
দেখুন শুধু লিথিয়াম পেলেই তো হল না। তার সঙ্গে প্রয়োজন কোবাল্ট বা নিকেল। বিশ্বের ৬০% কোবাল্ট রয়েছে আফ্রিকার কঙ্গোতে। আর এই দেশের ৭০% কোবাল্ট মাইনিংয়ের জন্য চুক্তি রয়েছে চিনের। চিনের হাতে রয়েছে মোট লিথিয়াম ভান্ডারের ১৩%। আর লিথিয়াম প্রোডাকশনের ৫৮% মার্কেট রয়েছে চিনের হাতেই। এছাড়া লিথিয়াম ব্যাটারি তৈরির জন্য যে অ্যানোড, ক্যানোড, সেপারেটরের প্রয়োজন তারও অধিকাংশ দখল করে রেখেছে চিন। কিন্তু ভারত সরকার এই গোটা সমীকরণটাই নিজেদের জন্য পাল্টাতে চাইছিল। তার জন্যই খোঁজ চলছিল লিথিয়ামের। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে এই পুরো প্রোডাকশন করার জন্য দুর্দান্ত ফেসিলিটির প্রয়োজন। লিথিয়াম রিফর্ম করার জন্য সবসময় হাই টেম্পারেচারের প্রয়োজন পড়ে। সেটা ৮০০ ডিগ্রি থেকে ১০০০ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। প্রয়োজন পড়ে প্রচুর পরিমাণ ফসিল ফুয়েলের। ফলে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণও অনেকটা বাড়ে। জানা গিয়েছে, ১ টন লিথিয়াম মাইন করার জন্য ১৫ টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে মেশে। আর প্রয়োজন জলের। ১ টন লিথিয়ামের জন্য প্রয়োজন পড়ে ২২ লাখ লিটার। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীরে এতো পরিমাণ জল ব্যবহার করা কি সত্যিই সম্ভব? এমনিতেই জম্মু-কাশ্মীরে জলের সমস্যা রয়েই গেছে। সুতরাং, বিষয়টা যত সহজ মনে হচ্ছে, একেবারেই কিন্তু সেটা নয়। তবে সব ভালো যার শেষ ভালো। একদিকে যখন পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের অবস্থা ভাঁড়ে মা ভবানি, তখন ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে লিথিয়ামের খোঁজ অবশ্যই দুর্দান্ত একটা জবাব ছুঁড়ে দেওয়া হবে প্রতিবেশী দেশকে। আর যদি সব দিক ঠিকঠাক রেখে ভারত সরকার লিথিয়াম ব্যাটারি নিজেই প্রোডিউস করতে শুরু করে, তাহলে বলাই বাহুল্য, জম্মু-কাশ্মীরের মানুষদের কাজের অভাব হবে না। একইসঙ্গে তাদের জীবন-জীবিকার মানে অনেকটাই হেরফের হবে। প্রচুর কর্মসংস্থান, এলাকার সামগ্রিক উন্নতি- এই সবই যেন নতুন করে শক্তি দেবে ভারতকে। একইসঙ্গে দেশের সার্বিক আর্থিক উন্নতিতে কার্যত গেম চেঞ্জার হয়ে উঠবে লিথিয়াম।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ