Trending
মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ ইজরায়েল। যে দেশের ইনফ্লেশন রেট ছিল পাকিস্তানের থেকেও অনেক বেশি। যে দেশের মাটি কৃষিকাজের জন্য একেবারেই উপযুক্ত ছিল না। যে দেশের পলিটিক্যাল স্টেবিলিটি আর আগের মতন ছিল না। যে দেশ চিনের মত মাস ম্যানুফ্যাকচার করতে পারত না, সেই ইজরায়েলকে আজ বিশ্বের প্রথম সারির প্রত্যেকটা দেশ কুর্নিশ করে। হাজারো বাধা থাকা সত্ত্বেও ইজরায়েল দিনে দিনে নিজের দেশের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্টকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আজ ইজরায়েলকে ইকোনমিক সুপারপাওয়ার নিঃসন্দেহে বলাই যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতো বাধা বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ইজরায়েল ইকোনমিক সুপারপাওয়ার হয়ে উঠল? সেই ফর্মুলা আমাদের এখানেও কি খাটানো উচিৎ? এই সব নিয়েই শুরু করা যাক আজকের প্রতিবেদন।
প্রথমেই বলি, ইজরায়েল ইহুদীদের দেশ। কিন্তু এই দেশটাকে চারপাশে ঘিরে রেখেছে অনেকগুলো মুসলিম দেশ। তারা আবার ইজরায়েলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কোনদিনই ইচ্ছে প্রকাশ করেনি। স্বাভাবিকভাবেই, ইজরায়েলের পক্ষে আর্থিক স্টেবিলিটি আনাটা খুব কঠিন হয়ে যায়। প্রতিবেশী দেশ যদি ট্রেডিং-এ ইন্টারেস্ট না-দেখায় তাহলে ইকোনমির জন্য সেটা তো বেশ চাপের বটেই। এদিকে ইজরায়েল দেশটাও এমন কিছু বড় নয় যে ম্যাসিভ কিছু পরিবর্তন এনে ইজরায়েল নিজের ইকোনমিকে ভালোরকম স্টেবল করতে পারত। অগত্যা, তাদের নজর দিতে হত গ্লোবাল মার্কেটের দিকেই। কিন্তু ব্যবসা করবে কী দিয়ে? সেদিক থেকে বলতে গেলে ইজরায়েলের ভাগ্য বেশ খারাপ। কারণ ইজরায়েল মিডল ইস্ট কান্ট্রি হলেও এই দেশে না পাওয়া গেছে তেলের খোঁজ, আর না-মিলেছে ভালোরকম ন্যাচারাল রিসোর্সেস। আর ইজরায়েলের মাটির কথা তো বললামই। দেশটার জমি কৃষিকাজের জন্য একেবারেই উপযুক্ত নয়। ফলে এগ্রি বিজনেস সেট আপ করাটাও যথেষ্ট কঠিন ছিল দেশটার জন্য। এদিকে দেশের জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। সুতরাং ম্যানুফ্যাকচারিং বেসড ইকোনমি তৈরি করাটাও ইজরায়েলের পক্ষে সহজ কাজ হল না। খুব বেশি নয়, আপনি যদি কয়েক বছর পর্যন্ত পিছিয়ে যান, তাহলেও দেখতে পাবেন যে, ২০০৯ সালেও ইজরায়েল তাদের জিডিপি-র ৫% খরচ করে ফেলত শুধুমাত্র তেল এবং অন্যান্য ন্যাচারাল রিসোর্সেস আমদানি করার জন্য। কিন্তু বিজনেস ডেভেলপমেন্ট- সেটা হচ্ছে কোথায়? অতএব, তৎকালীন সরকার পর্যন্ত বুঝেছিল যে, নিজেদের মধ্যে হ্যাভক কোন পরিবর্তন না-আনলে এই দেশের ইকোনমিকে কোনভাবেই স্টেবল রাখা যাবে না। ১৯৮০ সালেও ইজরায়েলে মূল্যবৃদ্ধি পৌঁছে যায় ৩৫০% মতন। বর্তমানে ভারতে ইনফ্লেশন রেট ৬% মতন আর পাকিস্তানে ৫০% মতন। তাহলে বুঝতেই পারছেন যে, ইজরায়েলের অর্থনীতি কিভাবে ধীরে ধীরে অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছিল। পরিস্থিতি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, ইজরায়েলের সাধারণ মানুষই আর নিজের দেশের কারেন্সিকে ব্যবহার করছিল না। স্বাভাবিকভাবেই, নিজের দেশের কারেন্সি যদি নিজের লোকেরাই ব্যবহার না-করে, তাহলে বুঝতে হবে যে কতটা অনাস্থা তৈরি হতে পারে। সাধারণ মানুষ তখন ডলার ব্যবহার বাড়িয়ে দিল ভালোরকম।
সব দেখেশুনে একটা বিষয় তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয়েছিল যে, ইজরায়েল সরকার ভালোরকম বুঝতে পেরেছিল, যদি নিজের দেশের কারেন্সির এই অবস্থা হয়, তাহলে কোন বিদেশি ইনভেস্টররা সেই দেশে আসার সাহস দেখাবেন না। অগত্যা, ইজরায়েলকে ভালোরকম কিছু ব্যবস্থা নিতে হত। তারই কনসিকুয়েন্স হল নতুন কারেন্সি। ইজরায়েল ১৯৮৫ সালে নিয়ে এলো নতুন কারেন্সি যার নাম দেওয়া হল নিউ ইজরায়েলি শেকেল। সত্যি বলতে কী, এই নতুন কারেন্সি ইজরায়েলের অর্থভাগ্য ঘুরিয়ে দাঁড় করাতে পারল না। অগত্যা নিয়ে আসা হল ইকোনমিক স্টেবিলাইজেশন প্ল্যান। এই প্ল্যানের লক্ষ্যই হচ্ছে কিভাবে কম খরচে প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইজরায়েলকে ধনী করে তোলা সম্ভব। তার জন্য সরকার প্রথমেই যেটা করল, নিজেদের খরচ কাটছাঁট করার পথে হাঁটল। এবং একইসঙ্গে ইজরায়েল নিজের দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক- ব্যাঙ্ক অফ ইজরায়েলকে পুরোপুরিভাবে ইন্ডিপেনডেন্ট করে দিল। অর্থাৎ ব্যাঙ্ক অফ ইজরায়েল আর কোনভাবেই ইজরায়েল সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চালিত হবে না। এটা একটা মেজর টারনিং পয়েন্ট হল বলাই যায়। কারণ এর ফলে ব্যাঙ্ক অফ ইজরায়েল নিজের মতন করেই অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে তার মোকাবিলা করতে পারবে। যেমন ইনফ্লেশন রেট বৃদ্ধি পেলে সুদের হার বাড়াতে পারবে এই কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। এর ফলে মার্কেটে ক্যাশের ফ্লো অনেকটাই থমকে যায়। টাকা ডি-ভ্যালু হওয়া থেকে কিছুটা বাঁচে। কিন্তু ইজরায়েল সরকার ইচ্ছাকৃত নিজের কারেন্সিকে ডি-ভ্যালু হতে দিল। মানুষের মধ্যেও নিজের দেশের কারেন্সি নিয়ে যে ডাউটসগুলো ছিল, সেগুলো ধীরে ধীরে কেটে যেতে শুরু করল। নিজের দেশের কারেন্সি আবার ব্যবহার করতে শুরু করল সেই দেশের মানুষ। তারপরেই দেখা গেল মূল্যবৃদ্ধি ৩৫০% থেকে পাঁচ বছরে নেমে এলো একেবারে ২০ শতাংশে! এছাড়া অফশোর ন্যাচারাল গ্যাস। যে পরিমাণ গ্যাসের খোঁজ ইজরায়েল পেয়েছিল, তাই দিয়ে হয়ত বিদেশে রফতানি করা সম্ভব হত না কিন্তু নিজের দেশের আভ্যন্তরীণ চাহিদা ভালোভাবেই মেটানো সম্ভব হল। এছাড়া রয়েছে টুরিজম বিজনেস। জুডাইজম, মুসলিম এবং ক্রিশ্চানদের জন্য ইজরায়েলের জেরুজালেম অত্যন্ত পবিত্র একটি জায়গা। প্রতি বছর ৪০ লক্ষ পর্যটক এই দেশে ঘুরতে আসেন। আর টুরিজমকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর বহু কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়। এতেও বিদেশি মুদ্রা অনেকটাই আসে ইজরায়েল সরকারের কাছে। আর এই সবকিছুকে বাদ দিলে পড়ে থাকে ব্রেন পাওয়ার। ডিফেন্স সেক্টরে ইজরায়েল নিজের ব্রেন পাওয়ারকে ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। ড্রোন, বন্দুক, মিসাইল সহ বিভিন্ন ধরণের ডিফেন্স সফটওয়্যার তৈরিতেও ইজরায়েল পিছিয়ে নেই। স্পাই সফটওয়্যার পেগেসাস ইজরায়েলের ব্রেনচাইল্ড- যার কথা হামেশাই আমরা শুনে থাকি। সঙ্গে রয়েছে আরএনডি প্রসেস চালিয়ে যাবার জন্য বড় অঙ্কের বরাদ্দ করা বাজেট। জানা যাচ্ছে, আমেরিকার থেকেও ইজরায়েল নিজের দেশে আরএনডি করার জন্য বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই ডিফেন্স সেক্টরে ইজরায়েল যেন ওয়ান অ্যান্ড ওনলি হয়ে উঠছে। এছাড়া ঐ দেশের সরকারের নির্দেশ, প্রত্যেককে মিলিটারি সার্ভিস দিতেই হয়। তারপর কেউ চাইলে সেই সার্ভিসকে বিদায় জানিয়ে প্রাইভেট কোম্পানি তৈরি করতে পারে। তার জন্য সরকার যথেষ্ট সাহায্য করছে। আর একটা বিষয়, এই সকল প্রাইভেট কোম্পানিগুলো কিন্তু এফএমসিজি সেক্টরে ছাপ ফেলেনি। বরং ডিফেন্স সেক্টরে নানান সরঞ্জাম তৈরি করে তারা।
সব মিলিয়ে ইজরায়েল আজ ভালো পজিশনে। দেশটা নিজের ইকোনমিক স্টেবিলিটি ভালোরকম তুলে ধরতে পেরেছে। আজ আমেরিকা থেকে ইউরোপ- সর্বত্র ইজরায়েলের জয়জয়কার। ফরেন ইনভেস্টমেন্ট আসছেও দুর্দান্ত। ইজরায়েলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। বিপদে আপদে রাশিয়ার-ই মত যার কেউ নেই তার ভগবান আছে গোত্রীয় বন্ধু হল ইজরায়েল। ইজরায়েল ভারতকে কিভাবে সাহায্য করছে সেই কথা বলব আরেকটা প্রতিবেদনে। আপাতত এইটুকুই।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ