Trending
একদিকে যখন সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির স্বপ্ন চুরমার, তখন অন্যদিকে গোল্ডম্যান স্যাকস দরাজ হাতে ভারতের অর্থনীতির ভাগ্যকে টেনে তুলে আনল সেকেন্ড পজিশনে। অর্থাৎ একদিকে যখন অর্থনীতির ভাগ্যদিশারি সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরির এখন প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে গেল, তখন ভারতের রাইজিং ইকোনমি নিয়ে কিভাবে এতটা আত্মবিশ্বাসী গোল্ডম্যান স্যাক্স? আর ভারত যদি সত্যিই দ্বিতীয় পজিশনে উঠে আসে, তাহলে দিনের শেষে কোথায় দাঁড়াবে চিন আর কোথায় দাঁড়াবে আমেরিকা? আসুন, আজকের প্রতিবেদন শুরু করা যাক এই নিয়েই।
গোল্ডম্যান স্যাক্স আমেরিকার মাল্টিন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠান। এই বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং, সিকিউরিটিজ, বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা- এইসকল ক্ষেত্রে নিজেদের পরিষেবা দিয়ে থাকে। মোদ্দা কথা, গোল্ডম্যান স্যাক্স এমন একটি প্রতিষ্ঠান যে কিছু বললে সেটাকে মান্যতা দেয় বিশ্বব্যাপী দেশগুলো। নিউ ইয়র্কে উপস্থিত এই প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর থেকেই প্রকাশ পেয়েছে একটি তথ্য। সেখানেই বলা হয়েছে, ২০৭৫ সালের মধ্যে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ ইকোনমি হতে চলেছে ভারত। তার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ দেখিয়েছে ঐ প্রতিষ্ঠান। সেগুলো কী কী? পপুলেশন, ইনোভেশন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যাধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার, ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের বৃষ্টি, আর পণ্য তৈরির করার ক্ষমতা। ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেসের একটি তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, বিনিয়োগ করার জন্য আদর্শ জায়গা হচ্ছে ভারত। টেক্কা দিয়েছে চিনকে। বলা হচ্ছে, ৮৫-টি সোভেরেন স্টেট এবং ৫৭-টি সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ভারতকে ইনভেস্টমেন্টের আদর্শ জায়গা বলে মনে করছে। যাদের সর্বমোট অ্যাসেট ভ্যালু প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন ডলার মতন। দেশে এতো বিনিয়োগ কেন? সেখানেও বলা হচ্ছে, চিনের থেকে ভারত নিজের বিজনেস এনভায়রনমেন্টকে আরও দারুণ জায়গায় নিয়ে যেতে পেরেছে। রয়েছে রাজনৈতিক স্থিরতা। রয়েছে উদ্যোগ। রয়েছে ব্যবসা ছড়ানোর জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়া।
সেই সুতোয় টান দিয়েই ভারতের জিডিপিকে একধাক্কায় টেনে তুলে দিল গোল্ডম্যান স্যাক্স। বলা হচ্ছে, ভারতের জিডিপি পৌঁছে যেতে পারে ৫২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে। স্বাভাবিকভাবে শুনেই যে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা দেখা দিয়েছিল সেটা মিলিয়ে যাবে অচিরেই। কারণটা এখনই বলছি। প্রথম, এই যে সম্পূর্ণ তথ্য এর মধ্যে শক্তপোক্ত কোন নিশ্চয়তা নেই। ভারত এই মুহূর্তে যে গতিতে এগোচ্ছে তারপর ভারতের এই দুর্দান্ত গ্রোথ আশা করাই যায়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বেশ কিছু বাধা এখনো রয়ে গেছে। যা ইকোনমিক গ্রোথকে কিছুটা হলেও ধাক্কা দিতে পারে। সেই তথ্যও দিয়েছে গোল্ডম্যান স্যাক্স। সংস্থার বক্তব্য, ভারতে কিন্তু এখনো পর্যন্ত দক্ষ শ্রমিকের রেশিও রয়েছে নিচের দিকে। এই কথাটা শুনেই মনে পড়ে গেল জিংপিং-এর একটা কথা। ভারত যখন পপুলেশনে চিনকে টেক্কা দিল, তখন চিনের সর্বময় কর্তা একটি কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলেই তো আর হবে না। প্রয়োজন দক্ষ স্কিল্ড কর্মী। সত্যিই তাই। ভারত যতক্ষণ না স্কিল্ড কর্মী তৈরি করতে পারবে, যতক্ষণ না কাজের নিরিখে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে, ততক্ষন পর্যন্ত ভারত নিজের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট সেভাবে তুলে ধরতে পারবে না। জুন মাসের একটা রিপোর্ট। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা করা হয় ভারতে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ভারতে সববয়সী মহিলা এমপ্লয়ির সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশ! অন্যদিকে আবার এটাও বলা হয়েছে যে, ভারতের মতো দেশে কি কখনই রিজিওনাল ইকোনমির গোঁত্তা খাওয়া উচিৎ? কিন্তু আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় বড় অঙ্কের বিনিয়োগ আসছে খুব ভালো কথা। একইসঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের উচিৎ রিজিওনাল ইকোনমির উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া। সেটা কি হচ্ছে? মনে হয় না। ভবিষ্যতে কিন্তু এটাই দেশের ইকোনমির গ্রাফ নিচের দিকে নামিয়ে আনতে পারে। অনেকেই স্বীকার করে নিচ্ছেন যে, ভারত যেভাবে হিমালয়ান ইকোনমির চূড়ায় উঠতে চাইছে এবং তার জন্য যে যে পদক্ষেপ নিতে চাইছে সেটা প্রশংসার যোগ্য ঠিকই। ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট, হাজার হাজার কোটির বিনিয়োগ- সবই ইন্ডিয়ান ইকোনমির প্রশস্ত সময়কেই পয়েন্ট আউট করছে। মনে করা হচ্ছে, ভারতের যা ডেমোগ্রাফিক পজিশন, সেটা বিশ্ব পুঁজিপতিদের জন্য বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু শুধু তাই দিয়ে কি আর ইকোনমিক গ্রোথ হতে পারে?
আইএমএফের ডেটার দিকে যদি নজর ঘোরাই, তাহলে দেখব, আমরা সকলেই জানি যে, ব্রিটেনকে সরিয়ে ভারত এখন পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। সামনে রয়েছে জার্মানি, জাপান, চিন এবং আমেরিকা। এক দশকের মধ্যে ১১ নম্বর পজিশন থেকে পাঁচে উঠে আসা মুখের কথা নয়। ২০২৭ সালের মধ্যে জার্মানিকে টপকে হয়ত চারেও চলে আসবে ভারত। সেই জায়গাটা তৈরিই হয়েছে লেবার ফোর্সের জন্য। কিন্তু সেকেন্ড পজিশনে ওঠার জন্য যে ভীষণভাবে এই লেবার ফোর্সকেই গুরুত্ব দিতে বলা হচ্ছে। আর্থিক বিশেষজ্ঞরা বারবার মনে করিয়ে দিতে চাইছেন যে, দেশে ক্যাপিটাল ইনভেস্টমেন্টের প্রয়োজন তো রয়েছেই। না-হলে দেশের ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট হবে কী করে? দেশের জিডিপিকে যদি সেভাবে ড্রাইভ করে নিয়ে যেতেই হয়, তাহলে দিনের শেষে একটাই কথা দক্ষ লেবার ফোর্স, লেবার ফোর্স আর লেবার ফোর্স। এই ছাড়া কোন গতি আপাতত নাই। তাই শুধু বিনিয়োগ আনলেই তো হল না। তাকে ধরে রাখতে হলে স্কিল দক্ষ কর্মী প্রয়োজন রয়েছে। না-হলে যে লক্ষ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে, সেই পদগুলো পূরণ হবে কী করে? অর্থাৎ, কলসি জলে ভরাট। কিন্তু কলসিতে যে ছোট ছোট অনেক ছিদ্র।
এমনিতেই সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরিতে ভেদান্তের হাত ছাড়ল ফক্সকন। প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি দেখিয়ে চিনকে টেক্কা দিতে তাইওয়ানের ফক্সকন আর ভারতের ভেদান্ত হাত মিলিয়েছিল, সেটা আপাতত বিশ বাঁও জলে। সেমিকন্ডাক্টর না হলে দেশের ইকোনমিক গ্রোথ ধাক্কা খাবে। সেটা নতুন করে বলার প্রয়োজন আশা করছি নেই। সুতরাং প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যে হাজার হাজার দক্ষ কর্মীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছিল, সেটা অনেকটাই ধাক্কা খেল। তবে কেন্দ্রীয় সরকার বলছে, একটা ডিল যদি ভেঙ্গেও যায় তাতে ভারতের ডেভেলপমেন্ট কোনদিক থেকেই থমকে যাবে না। কিন্তু বিষয়টা একটা বলে নয়। এভাবেই যদি একের পর দুই, দুই-এর পর তিন- লাগাতার এভাবে বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হাতছাড়া হয়ে যায় তাহলে আর কোথায় চিনকে টেক্কা দেবার স্বপ্ন? তাছাড়া ২০৭৫ সালে ইন্ডিয়া যে সেকেন্ড লারজেস্ট ইকোনমি হবে বলছে, সেখানে চিন আর আমেরিকা কোথায় থাকবে? আমেরিকা ধাক্কা খাবে ভারত এবং চিনের কাছে। নেমে আসবে তিন নম্বরে। আর চিন…শেষ হাসি হাসবে স্বয়ং জিংপিং। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ইন্দো-চিনি ভাই ভাই যেন। একে চিন, দুয়ে ভারত তিনে মার্কিন মুলুক। এটাই হচ্ছে ভবিষ্যতের প্রেডিকশন। এখন ৫০ বছর পর ভারত আর চিনের সম্পর্ক কোথায় দাঁড়াবে সেটা বলবে সময়। তবে গোল্ডম্যান স্যাক্সের মতন আপনারাও একটা অনুমান তো করতেই পারেন।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ