Trending
এই তো কয়েক মাস আগের কথা। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের নিরিখে চিনকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল আমেরিকা। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রক সেই তথ্য প্রকাশও করে। গেল অর্থবর্ষে ভারতের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেনদেনের অঙ্ক যেখানে ছিল ৮০০ কোটি ৫১ লক্ষ ডলার, সেখানে এই অর্থবর্ষে দুই দেশের বাণিজ্যের অঙ্কটা পৌঁছে যায় ১১ হাজার ৯৪২ কোটি ডলারে। দুই দেশের মধ্যে আমদানি, রফতানি আলাদা বার্তা পৌঁছে দেয় চিনের কাছেও। সেটা চিনের জন্য খানিক অস্বস্তির তো বটেই। কারণ, ভারতের সঙ্গে চিনের যে ব্যবসা-বাণিজ্য চলছিল, সেটা স্বাভাবিকভাবেই দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করছিল। কিন্তু চিনের স্বভাব- ঐ স্বভাব যায় না মলে। একদিকে চিনের রাষ্ট্রপ্রধান ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত করছে, আবার অন্যদিকে সীমান্তে ভারতকে লাগাতার খুঁচিয়ে চলেছে চিন। কেন্দ্রীয় সরকার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং লাদাখ সীমান্তে চৈনিক দ্বিচারিতা বেশ অস্বস্তি এবং চিন্তায় ফেলে দিয়েছে সাউথ ব্লককে। তাই বাইডেন-মোদীর উষ্ণ আলিঙ্গন চিনকে অন্য একটা বার্তা তো দেবেই। সেটা চিনের চক্ষুশূল হতেই পারে। কিন্তু বার্তা দেওয়ার প্রয়োজন যে ছিল, সেটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু এবার আরও একটা ব্রহ্মাস্ত্র ব্যবহার করল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তারা জানিয়ে দিল, কারেন্সি মনিটরিং লিস্ট থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে ভারতকে। অবশ্য, শুধু ভারত নয়। তালিকা থেকে সরানো হয়েছে ইতালি, মেক্সিকোর মতন দেশকেও। কিন্তু মনিটরিং লিস্টে এখনো ঠাঁই রয়েছে চিন সহ আরও ছয়টি দেশের। সেগুলি হল জাপান, কোরিয়া, জার্মানি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং তাইওয়ান। এবার বলি এই মনিটরিং লিস্ট ব্যপারটা কি। কিন্তু সেটা জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে, কাকে বলে কারেন্সি ম্যানিপুলেশন।
ধরে নেওয়া যাক দুটো দেশ- ভারত এবং আমেরিকা। ভারতে চলে রুপি, আমেরিকায় ডলার। এবার ধরুন, ভারত রুপির ভ্যালু ইচ্ছাকৃতভাবে ডলারের নিরিখে কমাতে শুরু করল। এতে লাভবান হবে ভারত। কারণ, আমেরিকায় বসে যারা ভারত থেকে জিনিস কিনতে চাইছেন, তাঁদের গ্যাঁটের কড়ি অনেকটাই কম খরচ করতে হবে। যে-কারণে আমেরিকায় ভারতের রফতানি বেড়ে যাবে অনেকটাই। কিন্তু ক্ষতির বহর বাড়বে আমেরিকার। কারণ আমেরিকায় বাণিজ্য ঘাটতি আরও চওড়া হতে শুরু করবে। এটা মার্কিন অর্থনীতির জন্য বেশ দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ইকোনমিক টাইমসের একটি রিপোর্ট বলছে, ২০২১ সালে মানে গেল বছরই আমেরিকা ভারতকে তাদের কারেন্সি মনিটরিং লিস্টে রেখেছিল। এই গোটা বিষয়টা নজরে রাখে আমেরিকার ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু এই গল্প বাঁক এন্য একেবারে অন্যদিকে যখন আমেরিকা তাদের কারেন্সি মনিটরিং লিস্ট থেকে নাম সরিয়ে দেয় ভারতের। আর এই পদক্ষেপটা নেওয়া হল তখনই, যখন মার্কিন মুলুকের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেন পা রাখলেন দিল্লিতে এবং গত শুক্রবার দেখা করলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের সঙ্গে।
চিনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক যে অতীতেও খুব একটা ভালো ছিল না, সেটা বলছে ইতিহাস। ৬২’র যুদ্ধের কথাই ধরা যাক। তখন ভারতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রয়েছেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু। চিনের অপ্রতিরোধ্য গতির কাছে ভারত তেমন পেরে উঠছিল না। সেই সময় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন কেনেডি। নেহেরু তাঁর কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। আমেরিকাও সাহায্য করবার জন্য প্রস্তুত ছিল। কিন্তু ততক্ষণে রাশিয়া কিউবাতে ব্যস্ত ছিল ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানোর ব্যপারে। দুই কমিউনিস্ট শাসিত দেশের খুঁচিয়ে ঘা করার কারণে চিন্তার ভাঁজ পড়েছিল ভারত এবং আমেরিকা- দুয়েরই কপালে। ফলে পারমাণবিক যুদ্ধ হওয়ার একটা আশঙ্কার বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। যাই হোক, যত দিনে আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়াবে বলে প্রস্তুত হল ততদিনে চৈনিক সৈনিকরাই নিজে থেকে পিছিয়ে এসেছে। সুতরাং, বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতের পাশে সেই সময়ও দাঁড়িয়েছিল আমেরিকা, এবং আজও দাঁড়াচ্ছে। এখন বিষয়টা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে আলাদা করে বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত কেন করতে চাইছে আমেরিকা? দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক মজবুত হলে সেই প্রভাব কি পড়বে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে?
নিঃস্বার্থের রাজনীতি তো হয় না। আমেরিকা বহুদিন ধরেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের দাদাগিরি লক্ষ্য করে চলেছে। তাই আমেরিকা চাইছে চিনের প্রভাব যেন-তেন-প্রকারেণ খর্ব করতে। তার জন্য এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলে চিন বিরোধী দেশগুলোর সঙ্গে নতুন করে আঁতাত তৈরির চেষ্টায় লেগে রয়েছে আমেরিকা। এদিকে আমেরিকার প্রভাব ছড়ানোর এই স্লো-প্রোগেসকেও ভালো নজরে দেখছে না চিন। যে-কারণে চিন মনে করছে, আমেরিকা নাকি এশিয়াতেও ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবহকে ফিরিয়ে আনতে উঠেপড়ে লেগেছে। কিন্তু চিন যাই মনে করুক না কেন, এশিয়াতে নিজের অধিকার ধরে রাখতে ভারতকে আমেরিকার সাহায্য নিতেই হবে। সেটা হবে চিনা আগ্রাসন নীতিকে কিছুটা ধাক্কা দেবার মতন। আর যে কারণেই, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি সেক্রেটারির উপস্থিতিতে নির্মলা সীতারামনের উচ্ছ্বাস প্রকাশ ঠারেঠোরে চিনকেই মিঠেকড়া বার্তা দেওয়া হল বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহল। এখন এর জবাব দিতে চিন কোন কৌশল গ্রহণ করে কিনা সেটাই দেখার।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ