Trending
ইকোলজি এবং ইকোনমি একে অপরের সঙ্গে ভালোরকম জড়িয়ে। আমজনতার মধ্যে বিষয়টা তেমন গুরুত্ব না-পেলেও কেন্দ্রীয় সরকার বর্তমানে বিষয়টা নিয়ে যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করছে। তার জন্যই বাঘ সংরক্ষণের বিষয়টা বারবার উঠে আসছে। প্রোজেক্ট টাইগারের গোল্ডেন জুবিলি চলছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সদ্য ভিজিট করে এসেছেন কর্ণাটকের বান্দিপুর এবং মুদুমালাই টাইগার রিজার্ভ। যেখানে ২০ কিমি জঙ্গল সাফারি করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। দেখা যাচ্ছে, এতদিনে প্রোজেক্ট টাইগার রিজার্ভ দুর্দান্ত একটা সাফল্যও পেয়েছে। ২০০৬ সালে যেখানে গোটা দেশে বাঘের সংখ্যা ছিল ১,৪১১ সেখানে ২০২৩ সালে বাঘের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩,১৬৭-তে। যারা ছড়িয়ে রয়েছে দেশের ৫৩টি টাইগার রিজার্ভে, ৭৫ হাজার স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে। ব্যাঘ্র গণনার সূচক করে দেখা গিয়েছে, গোটা বিশ্বের নিরিখে ৭৫% বাঘ রয়েছে শুধুমাত্র আমাদের ভারতেই। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন যে, বাঘের সংরক্ষণ যেমন একদিকে প্রকৃতি সংরক্ষণের দিকটা ভালোরকম খেয়াল রাখছে তেমনই এই বাঘের হাত ধরেই কিন্তু দেশে ইকোনমিক গ্রোথ, কর্মসংস্থান সবই হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে আরও হতে পারে। আজকের প্রতিবেদন হতে চলেছে খুবই ইন্টারেস্টিং।
কয়েক দশক আগে পর্যন্ত গোটা এশিয়া জুড়ে বাঘের সংখ্যা ছিল ভালোরকম। একশো বছর আগে এশিয়াব্যাপী বাঘের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ মতন। কিন্তু আজ সেই সংখ্যাটা নেমে এসেছে ৫ হাজারের নিচে। আর যে কারণে বাঘ আজ বিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে, ইংলিশে যাকে বলা হয় এনডেঞ্জারড স্পিসিস। একদিকে যখন এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় বাঘের সংখ্যা নিচের দিকে ছিল, তখন ভারতে কিন্তু বাঘের সংখ্যা নজিরবিহীন বৃদ্ধি পেয়েছে। এর জন্য শুধু প্রকৃতির ওপরেই ভরসা করেনি সরকার। জোরালো পরিকল্পনার সঙ্গে প্রতি বছর খরচ করছে ৩৫ মিলিয়ন ডলার- শুধুমাত্র বাঘ সংরক্ষণের জন্য। আমরা সকলেই জানি যে, বাঘের সংখ্যা নজিরবিহীনভাবে কমার অন্যতম কারণ হল চোরাশিকার। একটা সময় ছিল, বাঘ শিকার যখন নিছকই শৌখিনতার মাপদণ্ড ছিল। শুধু আমাদের দেশ বলেই নয়। গোটা বিশ্বে যেখানে বাঘের অস্তিত্ব ভালোরকম ছিল, সেখানেই বাঘ শিকার স্টেটাস সিম্বল হিসেবে বিবেচনা করা হত। একটা সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, কালো বাজারে মরা বাঘ বিক্রি করা যেত ৬০ হাজার মার্কিন ডলারে, খুব সহজে। কিন্তু শিকার বা চোরা শিকারের কারণেই যে বাঘের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে এমনটা কিন্তু নয়। তার জন্য দায় বর্তায় বনভূমির আয়তন দিনে দিনে কমে আসার দিকেও। ফলে বাঘে-মানুষের সংঘাত আরও বাড়ছে।
আমরা সকলেই জানি যে, ফুড চেনে একেবারে ওপরের সারিতে থাকে বাঘ। তাই বাঘ সংরক্ষণ করতে গেলে পুরো ইকোসিস্টেমকে সংরক্ষণ করা ভীষণ প্রয়োজন। একটি বাঘ সংরক্ষণ করলে ২৫ হাজার হেক্টর অরণ্যভূমি সংরক্ষণ করা যায়। তবে বাঘ সংরক্ষণ মানেই যে শুধু বাঘ বা বনাঞ্চলের সংরক্ষণ- এমনটা কিন্তু নয়। এই উদ্যোগ অন্যদিক থেকে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয়গুলোর দিকেও বেশ ভালোরকম প্রভাব ফেলে। তৈরি হয় কর্মসংস্থান। বাঘ সংরক্ষণ করলে সবার প্রথমে আসে ট্যুরিজমের প্রসঙ্গ। যা স্থানীয় মানুষদের উপার্জনের খুব বড় একটা দিক খুলে যায়। দাঁড়ান, দাঁড়ান। এখানেই শেষ নয়। টাইগার রিজার্ভে খুব বড় মাত্রায় কাজ করে মিষ্টি জলের প্রবাহ। সেই মিষ্টি জলের প্রবাহ স্থানীয় মানুষের জন্য পানীয় জলের সমস্যা মেটায়। সেচের জন্য আলাদা করে জল নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা থাকে না। একইসঙ্গে মাছ চাষের জন্য সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভারত সরকার এই গোটা বিষয়টাই কিছুটা হল বুঝতে পেরেছে। বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তৈরি করা যেতে পারে যদি বাঘ সংরক্ষণের প্রচেষ্টা জারি থাকে।
১৯৭৩ সালে ভারত সরকার প্রথমবারের জন্য লঞ্চ করে প্রোজেক্ট টাইগার কনজারভেশন প্রোগ্রাম। সেই সময় গোটা দেশে টাইগার রিজার্ভের সংখ্যা ছিল ৯টি। কিন্তু আজ সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩টি টাইগার রিজার্ভে। আর প্রত্যেকটি টাইগার রিজার্ভ দেশের অর্থনীতিকে লাভবান করতে সক্ষম। তার জন্যই ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ফরেস্ট ম্যানেজমেন্ট দশটি টাইগার রিজার্ভের উপরে সমীক্ষা চালায়। খোঁজার চেষ্টা করে কিভাবে এই দশটি টাইগার রিজার্ভ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করে তুলতে পারে। তার জন্য তাদের ম্যানেজমেন্ট বাবদ প্রতি বছর কত টাকা খরচ হয়, তার একটা বিচার করা হয়। মেলঘাট টাইগার রিজার্ভ, যা রয়েছে মহারাষ্ট্রে, সেখানে প্রতি বছর ম্যানেজমেন্ট বাবদ খরচা হয় বছরে ২৬ হাজার ডলার। যা দশটি টাইগার রিজার্ভের মধ্যে সর্বনিম্ন। আর সবথেকে বেশি খরচ করা হয় শ্রী শাইলেম টাইগার রিজার্ভে। এখানে খরচ করা হয় ৫ লক্ষ ৬৯ হাজার ডলার। এবার বলা যাক, বাঘ সংরক্ষণের কী কী ডিরেক্ট এবং ইনডিরেক্ট বেনিফিট রয়েছে।
যদি সরাসরি লাভের দিকে খেয়াল রাখি, তাহলে বলা যেতে পারে, কর্মসংস্থান, গবাদি পশুর খাদ্য, কাঠ, ফুয়েল উডের মতন বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে যেখান থেকে সরাসরি লাভবান হওয়া সম্ভব। আর যদি ইনডিরেক্ট বেনিফিটের কথা ভাবি, তাহলে অবশ্যই প্রথমে আসে কার্বনের পরিমাণ অনেকটা কমিয়ে আনে। সয়েল কনজারভেশনে গুরুত্বপূর্ণ ছাপ রাখে। আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের মত বেশ কিছু দিক রয়েছে, যা টাইগার রিজার্ভ করলে সম্ভব। এছাড়া বলা হচ্ছে, শুধুমাত্র ঐ দশটি টাইগার রিজার্ভে বয়ে যাওয়া জল প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি তৈরি করতে সক্ষম। আর দশটি টাইগার রিজার্ভ সবমিলিয়ে প্রায় ৭৮ বিলিয়ন ডলার লাভ করাতে সক্ষম।
বাঘ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, আমাদের দেশে এখনো এমন বনাঞ্চল রয়েছে যেখানে আরও ১ হাজার থেকে দেড় হাজার মত বাঘ স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেরাতে পারে। তার জন্য ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগঢ়, উড়িষ্যা, অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজোরামের বনাঞ্চলকে এগিয়ে রাখা হচ্ছে। তার জন্য বন সংলগ্ন গ্রামবাসীদের আলাদা ইনসেন্টিভ দেওয়া হবে বলেও জানা গিয়েছে। অর্থাৎ, একদিকে কর্মসংস্থানের অনেক সুযোগ তৈরি হবে। স্থানীয় মানুষরা আয়ের অনেকগুলো পথ খুঁজে পাবেন। সেটা ট্যুরিজমের খাতিরে হোক বা ফিস হ্যাচারি হোক। এছাড়া প্রকৃতি সংরক্ষণের দরুন আমরা অন্য অনেকদিক থেকে ভালোরকম লাভবান হব। যেখানে আমাদের প্রচুর টাকা খরচ হয়ে যেত, সেই অর্থগুলো আমাদের বাঁচবে ভালোরকম। একটি তথ্য থেকে আমরা জানতে পারছি, যদি দশটি টাইগার রিজার্ভ ঠিকঠাকভাবে সরকারের নজরে থাকে, তাহলে ২০২২-২৩ অর্থবর্ষের জিডিপি-র ২.২% আসবে শুধু এই রিজার্ভ থেকেই। খেয়াল রাখার মতন বিষয়, যারা জঙ্গলপ্রেমী, তাঁরা কিন্তু জঙ্গলে ফিরে যান বাঘ দেখার আশায়। সুতরাং বাঘের সংখ্যা বাড়লে পর্যটকদের সংখ্যায় কোনরকম কমতি হবে না। আর এই সব দিকে নজর দিয়েই এখন বাঘ সংরক্ষণের বিষয়টা এতো গুরুত্ব পাচ্ছে। আপনার কি মনে হয়? বাঘ সংরক্ষণ করার জন্য সরকারের আর কোন কোন দিকগুলো বিবেচনা করা উচিৎ? জানান কমেন্ট বক্সে।
বিজনেস প্রাইম নিউজ
জীবন হোক অর্থবহ