Daily
মহানগরের মহাযানজট। ধরুন, আপনি রয়েছেন বেহালায়। সন্ধ্যের সময় যেতে চাইছেন শিয়ালদায়। এবার ভুলে যান মেট্রোর কথা। ভাবুন ঐ মহাযানজট পেরিয়ে কিভাবে এবং কতক্ষণে আপনি পৌঁছবেন স্টেশনে। মানে যে সময়টা লাগার কথা, তার থেকে কম সময়ে আপনি হয়ত পৌঁছে যেতে পারবেন দিল্লি থেকে মুম্বই। না…না…ভুল করবেন না। মোটেই আকাশপথে নয়। কারণ, আকাশপথেও এইটুকু সময়ে দিল্লি থেকে মুম্বই পৌঁছনো সম্ভব নয়। তাহলে? মাত্র ৫৫ মিনিটে দিল্লি থেকে মুম্বই পৌঁছবেন কি করে? এই প্রশ্নটা তৈরি হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যদি ভারত সরকারের ভবিষ্যৎ প্ল্যান-প্রোগ্রাম দেখেন, তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন যে ৫৫ মিনিটে পৌঁছে দেবার কথাটা একেবারেই ফেক নয়। কারণ, আসতে চলেছে ভারতে ‘হাইপারলুপ প্রোজেক্ট’। অর্থাৎ এই প্রোজেক্টের সফরসঙ্গী যদি আপনি হন, তাহলে ভ্রমণ করার চিরাচরিত অভিজ্ঞতা আপনার একেবারে ভেঙে যাবে। কারণ হাইপারলুপে ট্রেন ছুটবে, তবে সেটা লাইনের ওপর দিয়ে নয়। বরং কিছুটা উড়ে উড়েই। অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই নাকি সত্যি হতে চলেছে ভারতে। কিভাবে, আসুন আজ এই নিয়েই শুরু করা যাক আমাদের প্রতিবেদন।
হাইপারলুপের ধারণা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন ইলন মাস্ক। তিনি ২০১২ সালে এই পরিকল্পনার কথা জানান। ট্রান্সপোর্টেশন মোডে হাইপারলুপ প্রকল্প একটা দুর্দান্ত জাম্প হতে চলেছে। আমরা সকলেই জানি যে, বর্তমানে আমরা চার ধরণের ট্রান্সপোর্টেশন মোড দেখতে পাই। জাহাজ, রেল, ট্রেন এবং বিমান। কিন্তু হাইপারলুপের মাধ্যমে আমরা পৌঁছে যেতে পারব ফিফথ মোডে। হাইপারলুপ ট্রেন হল এমনই একটি ট্রেন যেটি যাতায়াত করবে পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ উৎস থেকে গন্তব্য- পুরো যাত্রাটাই হবে পাইপলাইনের মাধ্যমে। তার মধ্যে দিয়েই ছুটবে ক্যাপসুল। বলা হচ্ছে, হাইপারলুপ হচ্ছে বর্তমান ট্রান্সপোর্টেশনের আধুনিকতম টেকনোলজি। এই টেকনোলজির মাধ্যমে প্রথমে তৈরি করা হয় বায়ুশূন্য একটি টানেল। আর দীর্ঘ সেই টানেলের মধ্য দিয়ে ছুটে চলে একটা ক্যাপসুল। যা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ছুটবে ঐ পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে। আসলে জানা যাচ্ছে যে, ক্যাপসুলের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল ভাবে তৈরি করা হবে বায়ুর চাপ। একেবারে প্লেনের মতন। এর ফলে যাত্রীদের শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে কোনরকম অসুবিধে হবার কথা নয়। অন্যদিকে ক্যাপসুলের বাইরেটা বা পাইপলাইনের ভেতরটা থাকবে বায়ুশূন্য। এর ফলে ট্রেনটি বা ক্যাপসুলটি কোন বায়ুজনিত বাধার মুখোমুখি হবে না। বরং দুর্দমনীয় বেগে সে ছুটতে থাকবে। আর যাত্রীদের ধারণা হবে, যেন তারা ছুটে চলেছেন বাতাসের ওপর ভেসে ভেসে। কেবলমাত্র অভিকর্ষজ ত্বরণের একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হতে পারে। মূলত ম্যাগনেটিক ভেরিয়েশন টেকনোলজি থাকার কারণে ট্রেনটির সঙ্গে ট্র্যাকের কোন যোগাযোগ থাকবে না। বরং সেটা সামান্য ভাসমান অবস্থাতেই ছুটতে থাকবে।
জানা যাচ্ছে, হাইপারলুপ ট্রেন চালানো শুরু করলে সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হবে অপ্রচলিত শক্তিকেই। মনে করা হচ্ছে, সৌরশক্তিকে ব্যবহার করেই হাইপারলুপ ট্রেনটি চালানো সম্ভব হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ৮৬ হাজার টন গ্রিন হাউস গ্যাসের উৎপাদন কম হবে। ফলে পরিবেশ দূষণের মাত্রাটাও অনেকটা কম হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে, ২০১৭ সালে মার্কিনী সংস্থা হাইপারলুপ ট্রান্সপোর্ট টেকনোলজিস বা এইচটিটির সঙ্গে হাত মেলায় অন্ধ্রপ্রদেশ গভর্নমেন্ট। জানা গিয়েছে, অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী থেকে বিজয়ওয়ারা পর্যন্ত ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করা হয়। প্ল্যানকে কাজে নামানোর জন্য পরিকল্পনা নেয় ব্রিটিশ সংস্থা ভার্জিন। এই গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং ব্রিটিশ ধনকুবের রিচারড ব্র্যানসন এই প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন। তবে একেবারে টাটকা খবর হল, বর্তমানে হাইপারলুপ প্রকল্প বাস্তবায়িত করার জন্য কানপুর আইআইটি দারুণ ভাবে কাজ করছে। গুডস ক্যারিং কার্গো হাইপারলুপ ট্রেনের ডিজাইন তৈরি করে নিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, আগামী ১ বছরের মধ্যে এর পাইলট প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে যাবে। জানা যাচ্ছে, এই হাইপারলুপ প্রোজেক্টের মাধ্যমে ১ কিলোমিটারের কনস্ট্রাকশন কস্ট দাঁড়াবে মাত্র ১৫ লক্ষ টাকা। এমনকি এই প্রকল্প চালু হলে তখন পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য কয়লা সংগ্রহ করার বিষয়টা নেহাতই সহজ হয়ে যাবে। কারণ প্রতি মিনিটে ২.৭ টন কয়লা সাপ্লাই করা যাবে হাইপারলুপ ট্রেনের মাধ্যমে।
প্রাথমিক পর্যায়ে পুণে থেকে মুম্বই পর্যন্ত এই হাইপারলুপ ট্রেন চালানোর জন্য খরচ হতে পারে ৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রাথমিক পর্যায়ে টাকার অঙ্কটা একটু বেশি ঠেকলেও পরবর্তীতে অন্যান্য খরচের ভার অনেকটাই কমে যাবে। জানা যাচ্ছে, বেঙ্গালুরু থেকে চেন্নাই- ৩৩৪ কিলোমিটার পথ পৌঁছনো যাবে ২০ মিনিটে। বেঙ্গালুরু থেকে থিরুবনন্তপুরম- ৭৩৬ কিমি পথ পৌঁছোনো সম্ভব ৪১ মিনিটে। জয়পুর হয়ে দিল্লি থেকে মুম্বই- ১,৩১৭ কিমি পথ পাড়ি দেবে মাত্র ৫৫ মিনিটে। এছাড়া বেঙ্গালুরু থেকে মুম্বই পৌঁছনো যাবে মাত্র ৫০ মিনিটে।
বর্তমানে, বিশ্বের সবথেকে দ্রুতগামী ট্রেন হল ট্রান্সর্যাপিড সাংহাই। এটি চলে ম্যাগনেটিক লেভিটেশনে, ৪৩০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টায়। জাপানেও পরীক্ষামূলকভাবে এই হাইপারলুপের প্রোজেক্ট নিয়ে চলছে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। আর বর্তমানে তাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে ভারত। জানা গিয়েছে, বিশ্বে যাত্রীবাহী প্রথম হাইপারলুপ ট্রেনটি চলবে আমেরিকার লস এঞ্জেলেস থেকে সান ফ্রান্সিসকো পর্যন্ত। এছাড়াও দুবাইতে নাকি হাইপারলুপ ট্রেনের প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। জানা যাচ্ছে, হাইপারলুপ প্রকল্প চালু হলে সেটা ইন্ডিয়ান ইকোনমির জন্য একটা মেজর জাম্প হতে পারে। দেশের অর্থনীতি এবং পরিবেশ দুই-ই শক্তপোক্ত হবে।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ