Trending
অর্গানিক ফারমিং করতে গেলে প্রয়োজন পড়ে প্রপার প্ল্যানিং। কৃষকদের এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করানোর জন্য সময়ও লাগে অনেকটা। মুশকিল হচ্ছে, যেটা করতে সময় লাগতে পারে অনেক, আর সেটাই এক দিনের মধ্যে করতে চেয়েছিল ভারতের প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। সেই দেশের প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষ ২০২১-এর এপ্রিল মাসে ঘোষণা করে দেন শ্রীলঙ্কায় শুধুমাত্র অর্গানিক ফারমিং হবে। এই একটি পদক্ষেপের কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। ইনফ্লেশন, বেকারত্ব, খাদ্যাভাবের মত একের পর এক সমস্যা শ্রীলঙ্কাকে ধসিয়ে দেয়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা যে কাজটা আজ করতে গিয়ে একেবারে ব্যর্থ হল, সেটাই করে দেখিয়েছিল সিকিম। কি করে অর্গানিক ফারমিং করে একটা রাজ্যের কৃষি অর্থনীতি সচল রাখা যায়, সেটা দেখতে হলে বা জানতে হলে সিকিমকেই রোল মডেল করতে হবে। সিকিম বিশ্বের একমাত্র রাজ্য যে প্রথম অর্গানিক স্টেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে ইউনাইটেড নেশন সিকিমের এই অ্যাচিভমেন্টকে স্বাগত জানিয়ে সম্মানিত করে সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং-কে। ৫১টি নমিনেটেড দেশকে হারিয়ে সিকিম ইউএন ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন, ওয়ার্ল্ড ফিউচার কাউন্সিল এবং আইএফওএএমের দ্বারা স্বীকৃত হয়। কিন্তু সিকিমকে পুরোপুরি ভাবে অর্গানিক স্টেট হিসেবে তৈরি করা একেবারেই সহজ ছিল না। তারপরেও একের পর এক প্ল্যানিং, সুশৃঙ্খল চেনের জন্যই আজ সিকিম এই সম্মান অ্যাচিভ করতে পারল। কিভাবে সেটা নিয়েই কথা বলব আজকের প্রতিবেদনে।
সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং জানিয়েছিলেন, রাজ্যকে পুরোপুরিভাবে অর্গানিক রাজ্যে ট্রান্সফর্ম করাটা প্রথম দিকে একেবারেই সহজ ছিল না। এর প্রভাব পড়েছিল রাজ্যের ফসল উৎপাদনে। কৃষকরাও ক্ষতির মুখে পড়ছিলেন। সর্বোপরি ক্ষতি হয়েছেল সিকিমের ইকোনমির। তারপরেও নিজের জেদ থেকে লক্ষ্য থেকে একবিন্দু সরে আসে নি সিকিম গভর্নমেন্ট। দেখুন, সিকিমে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফারমিং-এর কোনরকম অনুমতি না থাকার কারণে আগে থাকতেই রাজ্যে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের ব্যবহার অন্যান্য রাজ্যের থেকে অনেকটাই কম হত। গ্রিন রেভল্যুশন হবার পর সিকিমের কৃষকরা কিছু কিছু ফসলের জন্য ফার্টিলাইজার ব্যবহার করতে শুরু করেন। কিন্তু তার ফলে এই রাজ্যে যে ফসল উৎপাদনে ম্যাসিভ কোন পরিবর্তন এসেছিল, সেটা কিন্তু বলা যায় না। আর এই সব কিছুর কারণেই, সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন কুমার চামলিং ২০০৩ সালে সিকিমকে পুরোপুরিভাবে অর্গানিক স্টেটে পরিণত করার একটা লক্ষ্য নেন। ২০১০ সালে তৈরি করা হল অর্গানিক মিশন। যা ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিকিমকে অর্গানিক স্টেট তৈরি করার জন্য একের পর এক স্টেপ নেবে। সত্যি বলতে কি সিকিম সাকসেসফুল হল। আজ রাজ্যের ১ লক্ষ ৯০ হাজার কৃষি জমিতে যে ফলন হয়, সেটা পুরোপুরিভাবে হয়ে থাকে অর্গানিক ফারমিং-এর মাধ্যমে। এর পিছনে নিঃস্বার্থভাবে যেমন কাজ করেছে সরকার বা প্রশাসন তেমনভাবেই এগিয়ে এসেছেন সেই রাজ্যের কৃষকরা।
সরকার শুরু থেকেই সিকিমের সাধারণ মানুষকে অর্গানিক ফারমিং-এর গুরুত্ব বোঝানোর দায়িত্বটা নিয়ে নেয়। তার জন্য চালু করে অর্গানিক ফার্ম, অর্গানিক স্কুল। এছাড়াও নিউট্রিশন ম্যানেজমেন্ট, পেস্ট ম্যানেজমেন্ট, ফারমিং ল্যাব ইন্ট্রোডিউস করে। একইসঙ্গে সয়েল কনসারভেশন, অ্যাসিডিক সয়েল ট্রিটমেন্ট, অর্গানিক প্যাকিং-এর মতন হাজারো বিষয় নিয়ে তারা মানুষের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তার জন্য প্রথম ধাপ হিসেবে বলতে হবে বায়ো ভিলেজের কথা। ২০০৩-০৪ সালে এবং ২০০৯-১০ সালে সিকিমের এগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্ট এবং ফুড সিকিওরিটি ৩৯৬টি গ্রামকে বায়ো ভিলেজে কনভার্ট করার দায়িত্ব নেয়। এই সকল গ্রামে কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারের ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। আর কৃষকদের চাষবাসের জন্য অর্গানিক ম্যানিওর প্রোভাইড করে। ২০০৪ সালে সিকিম স্টেট অর্গানিক বোর্ড একটা পলিসি গ্রহণ করে। বোর্ড মারফৎ বলা হয়, সিকিম অন্য কোন রাজ্য থেকে আর ফার্টিলাইজার ইমপোর্ট করতে পারবে না। কেমিক্যাল ফার্টিলাইজারে সমস্ত সাবসিডিজ তুলে নেওয়া হয়। আর ২০১৪ সালে পুরোপুরিভাবে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। আর কেউ যদি এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে, সেক্ষেত্রে তার জরিমানা হতে পারে ১ লাখ পর্যন্ত। সঙ্গে ৩ মাসের জেল। কিন্তু সিকিম সরকার পাশাপাশি কৃষকদের অর্গানিক ম্যানিওর এবং পেস্টিসাইড ব্যবহারের ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছিল। ৬ বছরে ১০ হাজার কৃষকদের এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিকিমের সরকার খুব ধীরে ধীরে এই নিষেধাজ্ঞা রাজ্যের মধ্যে ছড়াতে পেরেছিল বলেই তেমন ভাবে রাজ্যকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়নি। কিন্তু এই যদি বিষয়টা তড়িঘড়ি সম্পন্ন করতে যেত, তাহলে সাকসেস পাওয়া নিয়ে প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে যেত- অনেকটা শ্রীলঙ্কার মতন।
এছাড়াও সিকিম সরকার কৃষকদের বিনামূল্যে ভারমিকমপোস্ট, কমপোস্ট পিটস, বায়ো ফার্টিলাইজার প্রোভাইড করে। এছাড়াও রাজ্যে দুটো বায়ো ফার্টিলাইজার ইউনিট সেট আপ করা হয়। প্রাইভেট অর্গানাইজেশনের সঙ্গে আলোচনাও সারা হয়। এছাড়া অর্গানিক এবং জেনেটিকালি মডিফায়েড সিডস কৃষকদের মধ্যে বিনে পয়সায় বিতরণ করে সিকিম সরকার। আর সবচেয়ে বড় কথা হল এই সকল অরগানিক প্রোডাক্ট বাজারে আসার পর সেটা সরকার নিজেই কিনে নিত। তারপর সেটাই ক্রেতাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিত, সঙ্গে এটাও বলত অরগানিক ফুডের কতটা প্রয়োজনীয়তা আজকের দিনে রয়েছে। এমনকি অরগানিক ফারমিং-কে রাজ্যের প্রাইমারি এবং সেকেন্ডারি স্কুলে অ্যাড করে দেওয়া হল। যাতে ছোট থেকেই শিশুদের মধ্যে এই বিষয়ে সম্যক একটা ধারণা তৈরি হয়। ২০১৬ সালে সিকিম সরকার রাজ্যে তৈরি করল ন্যাশনাল অরগানিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট। আর এভাবেই বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং কৃষিকাজের মধ্যে অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধন তৈরির কাজটা সিকিম সরকার করে। আর সেটাই দারুণভাবে গ্রহণ করে নেয় সিকিমের সাধারণ মানুষ।
কিন্তু শ্রীলঙ্কার উদ্দ্যেশ্য ভালো থাকলেও, গোটা বিষয়টা একটা দেশে ইমপ্লিমেন্ট করার জন্য যে দূরদর্শিতার প্রয়োজন পড়েছিল, সেটা শ্রীলঙ্কার সরকার দেখতে পারেনি। রাতারাতি ৬০০ প্রোডাক্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাজারে ফার্টিলাইজারের আকাল দেখা দিতে শুরু করে। ধানের ফলন এক ধাক্কায় ২০% কমে যায়। ধাক্কা খায় চায়ের উৎপাদন। আর এই সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাটা একেবারে আটকে দেয়। আর সেই কারণেই বলা, চাইলেই করে ফেললাম বিষয়টা কিন্তু একেবারেই এতো সোজা নয়। আজ সিকিম বিশ্ব দরবারে সমাদৃত। কিন্তু এই জায়গাটা অ্যাচিভ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতি, রাজ্যের ক্ষতি সব কিছুরই ভয় এসে জমা হয়েছিল। কিন্তু দূরদর্শীতার পরিচয় দিয়ে সিকিম সরকার আজ প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে কিভাবে অরগানিক স্টেট হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানো যায়। প্রতিবেদনটির মাধ্যমে শেষে একটাই কথা। আজ এগ্রিকালচারাল ফিল্ডে সিকিম যা করে দেখিয়েছে, হিমালয়ের কোলে অবস্থিত এই ছোট্ট রাজ্যটির কারণেই ভারত গর্ব অনুভব করছে। কিন্তু সেই একই জিনিস নিজের দেশে প্রয়োগ করতে গিয়ে ভরাডুবি হয়েছে শ্রীলঙ্কার।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ