Trending
তালেবান- এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ভয়, সন্ত্রাস, নির্বিচারে হত্যা, অমানুষিক অত্যাচারের মতন একাধিক বিশেষণ। আজ গোটা বিশ্ব তালিবান শব্দটার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত। আফগানিস্তানের ভূমিসংগঠন হিসেবে তালেবানের নাম করা যেতে পারে। দেশটির দখল নেওয়ার পর থেকে গোটা বিশ্ব ধরে নিয়েছিল, তালেবানি শাসন চালু হওয়া মানে দেশটায় নৈরাজ্য, সন্ত্রাস, নারী স্বাধীনতা খর্ব হবার মতন ঘটনাগুলো আরও বেশি করে ঘটবে। কট্টরপন্থী তালেবানের সন্ত্রাস যে আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষের অস্তিত্বকে নড়িয়ে দিয়েছিল, সেই হাড় হিম করা ছবি আমরা সকলেই দেখেছি। অনেকেই বলেছিলেন, তালেবানি শাসন শুরু হওয়া মানে সেই দেশ ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং অন্ধ কুসংস্কার এবং সন্ত্রাসের ভিত্তি নিয়ে এগিয়ে যাবে। আর অর্থনীতি, রাজনীতি, সুস্থ সমাজনীতির উপর ছড়িয়ে দেবে গোলা, বারুদের চিহ্ন। আজ তালেবানি শাসন কথাটা আমরা সেভাবেই ব্যবহার করে থাকি। এই ধরণের উপমা ব্যবহারের কারণ একটাই। তালেবান মানেই সন্ত্রাস। তালেবান মানেই স্বেচ্ছাচারিতা। কিন্তু এই তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান কিভাবে? আফগানিস্তানের মতন পিছিয়ে পড়া দেশে কিভাবে তালেবানের মত সংগঠন এতো এতো অস্ত্র কেনার মত সাহস এবং সামর্থ্য পেল? আসুন, আজকের প্রতিবেদনে কাটাছেঁড়া করা যাক তালেবানের অতীত এবং বর্তমান নিয়েই।
তালেবান, পশতু ভাষায় যার অর্থ-ছাত্র। বলা হয়, নব্বই দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তানের উত্তরাংশে এই সংগঠনটির জন্ম হয়। যারা মূলত পশতুনদের অধিকার রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিত। আফগানিস্তান থেকে যখন সোভিয়েত সৈন্যরা পিছনে যেতে শুরু করল, তারপর থেকেই তালেবানরা ফ্রন্টফুটে আসতে শুরু করে ধীরে ধীরে। সেই সময় যে মাদ্রাসাগুলো ছিল, সেই মাদ্রাসাগুলো পুরোটাই চলত সৌদি আরবের অর্থায়নে। কট্টর সুন্নী মতাদর্শের ইসলাম প্রচার করাই ছিল এদের লক্ষ্য। এই মাদ্রাসাগুলোতেই তালেবানরা সংগঠিত হতে শুরু করে। তালেবানদের ভাবনাচিন্তা ছিল খুব স্পষ্ট। তাদের দাবি ছিল, ক্ষমতার অধিকার পেলে তারা শান্তি এবং স্থিতিশীলতার পক্ষে হাঁটবে। সঙ্গে জারি করবে কঠোর শরিয়া শাসন। পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় যে পশতুনদের বসবাস অনেকটাই বেশি। তালেবানদের কাছে এই এলাকাগুলোতে নিজেদের ভাবনাচিন্তার প্রসার ঘটানোর জন্য তেমন একটা কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। এখানেই তারা এই ধরণের প্রতিশ্রুতি দেয়। তার আরেকটা কারণ হল, সোভিয়েত সৈন্যরা আফগানিস্তানের মাটি ছাড়লে, সেখানে মুজাহিদীনদের মধ্যে ব্যপক অন্তরদ্বন্দ্ব দেখা দিতে শুরু করে। যার প্রভাব পড়েছিল সেখানকার সাধারণ মানুষদের ওপর। তারা তখন একটা শান্তির পথ খুঁজেছিলেন। তালেবান সংগঠন কিছুটা সেই কাজই করল। ফলে, আফগানদের মধ্যে তালেবানের ভাবপ্রচার বেশ কাজে দিল। তালেবানরা দুর্নীতি রুখে দেবার মত কাজটি ভালোভাবে করে। একইসঙ্গে আফগানিস্তানে আইন শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনে। আফগানিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমশই একটা নিরাপদ জায়গা খুঁজে পেতে শুরু করে। বলা হয়, আফগানিস্তানের দক্ষিণ পশ্চিম এলাকা থেকেই তালেবানি প্রভাব ব্যপকভাবে ছড়াতে শুরু করেছিল। ১৯৯৫ সাল। তারা প্রথম আফগানিস্তান এবং ইরানের সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত হেরাত প্রদেশটি দখল করে নেয়। তারপর তাদের দখলে আসে রাজধানী কাবুল। এবং ধীরে ধীরে ১৯৯৮ সাল নাগাদ আফগানিস্তানের ৯০ শতাংশ এলাকা দখল করে তালেবানরা।
তালেবান শাসনের মাধ্যমে আফগানরা সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন আশা করেছিল। কিন্তু দেখা গেল কট্টরপন্থী হবার কারণে তালেবানরা শাসন চালানোর নামে শুরু করল একের পর এক সন্ত্রাস। তবে অনেকেই সেই সময় একে সন্ত্রাস বলতে ঠিক রাজি হয়নি। কারণ, তারা কঠোর শরিয়া শাসনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেবার কাজটি চালু করে দেয়। যারা অপরাধী তাদের রাস্তায় জনসমক্ষে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। কেউ চুরি করলে তার হাত কেটে দেওয়া হত। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মহিলাদের শরীর পুরোপুরিভাবে বোরখার আড়ালে রাখাটা বাধ্যতামূলক করে দেয় তারা। সঙ্গে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় সিনেমা, গান এবং টিভি। মহিলাদের শিক্ষার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। শুধু তাই নয়। তালেবানরা যখন সেই সময় নিজেদের অধিকার শক্ত রাখতে পেরেছিল, সেই সময় তালেবানদের হাতেই ধ্বংস হয়ে যায় আফগানিস্তানের বিখ্যাত বামেয়ান বুদ্ধমূর্তি। তালেবানরা যে সংস্কৃতির চিরাচরিত ঐতিহ্যের একেবারে উল্টো পথে হাঁটছে, সেই নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলে। আন্তর্জাতিক মহলে ওঠে ব্যপক নিন্দার ঝড়।
উল্লেখ্য, তালেবানদের সঙ্গে পাকিস্তানের যে গভীর এবং গোপন আঁতাত রয়েছে সেটা বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মিডিয়া বলে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই, সব তথ্যকে সমূলে অস্বীকার করেছে পাকিস্তান। কিন্তু ভুললে চলবে না যে, তালেবানরা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়া যে আরেকটি দেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেটা হল পাকিস্তান। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমের বেশ কিছুটা অঞ্চলে তালেবানরা নিজেদের রক্তচক্ষু দেখাতে শুরু করে। পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা নষ্ট করে দেবার কাজটাও তালেবানরা করেছিল ভালোভাবে। মনে পড়ছে ২০১২ সালের অক্টোবর মাসের কথা? হত্যার ছক কষে গুলি চালায় পাকিস্তানের এক ছাত্রী মালালা ইউসুফজাই-এর ওপর। তারপর পেশোয়ারে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে বেশ কিছু স্কুল পড়ুয়ার জীবন এবং ভবিষ্যৎ অচিরেই মিশিয়ে দিয়েছিল তালেবান। বলাই বাহুল্য, এই ঘটনার দরুন গোটা বিশ্ব তালেবানদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। পাক সামরিক বাহিনী দুর্দান্ত অপারেশন চালাতে শুরু করে। ক্রমশই দেখা যায়, তার পর থেকেই তালেবানদের শাসনক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকল। ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ড্রোন হামলা চালাল। মৃত্যু হল পাকিস্তানের তালেবান নেতা হাকিমুল্লাহ মেহসুদের।
২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আক্রমণ করা হলে তখন এর পেছনে তালেবানের মগজ যে পুরোমাত্রায় কাজ করছে, সেই বিষয়ে গোটা বিশ্ব একমত হয়। আর এই পুরো ঘটনার মাস্টারমাইন্ড কে? নান আদার দ্যান ওসামা বিন লাদেন। আল কায়েদা আন্দোলন এবং লাদেনের যাবতীয় সুরক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে তালেবান- এটাই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। সেই সময়ই জানা যায় যে তালেবানদের অনেক সিনিয়র নেতাই নাকি পাকিস্তানের কোয়েটা শহরে নিশ্চিন্তের ঘাঁটি গেঁড়েছেন। তার কারণ, আফগানিস্তানে সেই সময় মার্কিন সামরিকবাহিনী প্রবল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলে তালেবানের সেই সময়কার বেশ কিছু মাথা- যেমন লাদেন, মোল্লাহ মোহম্মদ ওমর এরা সকলেই যেন হঠাৎ করেই বেপাত্তা হয়ে যান। তারপরেই পাকিস্তানের মদতে তালেবানরা পরিপুষ্ট হচ্ছে- এটাই শিলমোহর পড়ে। তবে সামনে না-এসেও যে নিজের কার্যসিদ্ধি চালানো সম্ভব, সেটা প্রমাণ করে দেখিয়ে দেয় তালেবানরা। আফগানিস্তানের বেশ কিছু অঞ্চলে তারা নিজেদের সহিংস ভাবধারা এবং অভ্যাসে ইতি টানে না। ২০১৫ সাল নাগাদ জানতে পারা যায়, তালেবান নেতা মোল্লাহ ওমরের মৃত্যু হয়েছে দু’বছর আগে। তার পরিবর্তে নেতা হন মোল্লাহ মনসুর। এবং তাঁর মৃত্যু হলে ২০১৬ সালে তালেবানের শীর্ষে বসেন হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা।
আমরা সকলেই জানি যে, ২০২০ সালে তালেবান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একটা শান্তি চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু শান্তি চুক্তির কোনকিছুই তালেবানরা ঠিক মানতে পারেনি। খুন, হত্যা, এই সবই চলছিল তাদের নিজস্ব নিয়মে। স্পেশ্যালি সাংবাদিক, শান্তির পক্ষে কথা বলা মানুষরাই ছিল তালেবানদের প্রধান লক্ষ্য। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যেন আফগানিস্তানে পুরোপুরি তালেবান ক্ষমতা দখলের রাস্তাটা একেবারে পরিষ্কার করে দেন। তাঁর নির্দেশ মতনই ঘরে ফিরে আসে সকল মার্কিন সৈন্যরা। এবং আফগান সরকারের পতন হয়। স্ব-মহিমায় ফিরে আসে তালেবান। তবে তালেবান সরকার আফগান অর্থনীতিতে যে পেরেক পুঁতে দিয়েছে সেটা এখনো বলা ঠিক হবে না। যদিও একটা সময় আফিমের চাষ করেই তালেবানরা নিজেদের অর্থনীতি চাঙ্গা রাখত, কিন্তু সম্প্রতি তালেবান সরকার চাইছে আফগানিস্তানে বিদেশী বিনিয়োগ আসুক। আফগানদের দেশীয় পণ্য ব্যবহার করার ব্যপারে প্রবল উৎসাহ দিয়ে চলেছে তালেবান সরকার। একইসঙ্গে নিজেদের অর্থনীতি মজবুত রাখার জন্য বিদেশী বিনিয়োগের ওপর ভরসা করছে তারা। ইরান, চিন এবং রাশিয়া তালেবানদের এই সকল বিষয়ে আশা দেখিয়েছে। একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের বিষয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে বেশ কিছু বিনিয়োগকারী। সেক্ষেত্রে এই সম্পদের মূল্য দাঁড়াতে পারে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে। লোহা, সীসা সহ বিভিন্ন খনিজে সমৃদ্ধ আফগানিস্তানের অর্থনীতি মজবুত করতে তালেবান পাশে চাইছে গোটা বিশ্বকে। এমনকি সম্প্রতি ভারতকেও আফগানিস্তানে বন্ধ থাকা প্রোজেক্ট সম্পূর্ণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে তারা। কিন্তু আদৌ কি কোন দেশ তালেবানি শাসনে নিজেদের এগিয়ে আনতে চায়?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ