Trending
যদি বলি, চিন আবারও একটি গ্রেট ওয়াল বা চিনের প্রাচীর তৈরি করছে, তাহলে অবাক হবেন? সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এমনিতে চিন যাই করে, সেটা বিশ্বের অন্যান্য দেশকে তাক লাগিয়ে দেয়। প্রত্যেকবারই চমক দেবার ক্ষেত্রে চিন যেন সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এবারেও তার অন্যথা হল না। কারণ, চিন ফের প্রাচীর তৈরি করার ব্যপারে উঠে পড়ে লেগেছে। তাও সেটা আজ নয়। বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই। কিন্তু এই প্রাচীর ইট, সিমেন্ট, সুরকি দিয়ে হবে না। বরং তৈরি করা হচ্ছে, গাছ দিয়ে। আবারও অবাক হলেন তো? হ্যাঁ, ঠিকই শুনলেন। চিন মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করার একটা মাস্টার প্ল্যান হাতে নিয়েছে। যার নাম দেওয়া হয়েছে, দ্য গ্রেট গ্রিন ওয়াল অফ চায়না। এখন আপনার মনে প্রশ্ন তৈরি হওয়া স্বাভাবিক যে হঠাৎ করে চিন কেন মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করতে চাইছে? আর কেনই বা সেটা সবুজ প্রাচীর হয়ে উঠছে? আজকের টপিকটা বেশ ইন্টারেস্টিং হতে চলেছে। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ইকোলজি থেকে ইকোনমি। পুরো বিষয়টা জানতে হলে, এই প্রতিবেদন স্কিপ করা যাবে না।
বর্তমানে চিনের আর্থিক বিকাশে অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চিনের মরুভূমি। যা অবস্থিত চিনের উত্তরাংশে। বলা হচ্ছে, এই মরুভূমি নাকি দিন দিন নিজের পরিধিকে ছড়াতে চলেছে, যেটা চিনের জন্য একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। চিন বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ একটি দেশ। ইকোনমিক সুপারপাওয়ার। কিন্তু কিছু কিছু তথ্য বলছে, এতো বড় দেশ হওয়া সত্ত্বেও যে পরিমাণ জমিতে চিনের চাষাবাদ হবার কথা ছিল, সেই পরিমাণ জমির অভাব রয়েছে চিনে। এদিকে চিনের উত্তরাঞ্চল অনেকটাই শুষ্ক মরুভূমিতে ঢাকা। তাই আধুনিক কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করছেন গবেষকরা। যে কারণে, পর্যাপ্ত জল, মাটি ছাড়াও চিন ভালোভাবে শস্য উৎপাদন করতে পারছে। তরমুজ, রসুন, টম্যাটো, পেঁয়াজের মত এমন হাজারো ফসল তারা উৎপাদন করছে। অর্থাৎ, ফসল উৎপাদনে চিনের বাহাদুরি কম নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্য একটা জায়গায়। চিনের সর্ববৃহৎ মরুভূমির নাম গোবি মরুভূমি। এটি পৃথিবীর অন্যতম শুষ্ক মরুভূমি। জানা গিয়েছে, মরুভূমির বালি হাওয়ার সঙ্গে উড়ে গিয়ে ঢেকে ফেলছে আবাদি জমির অনেকটা অংশ। এর ফলে চাষবাসের ব্যপক ক্ষতি হবার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আবার একইসঙ্গে চিনের রাজধানী বেজিং পর্যন্ত সেই মরুধুলোয় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
এদিকে গোদের ওপর বিষফোঁড়া মরুভূমির আয়তন বৃদ্ধি। প্রত্যেক বছর নাকি গোবি মরুভূমির দখলে চলে যাচ্ছে ৩,৬০০ বর্গ কিলোমিটার ঘাসজমি। আর সেটাই ব্যপকভাবে ক্ষতির বহর বাড়িয়ে তুলছে চিনের। কারণ আবাদি জমিগুলো একেবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর শুধু চিন বলেই নয়। মরুঝড়ের প্রভাব যে গতিতে বাড়ছে, তার ফলে সমস্যা দেখা দিচ্ছে উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানেও। কৃষিকাজে এই ব্যপক ক্ষতি হবার কারণেই আর চুপ করে বসে থাকে নি চিন। গ্রহণ করেছে বিকল্প ব্যবস্থার। ১৯৭৮ সালে চিন সরকার প্রথম গোবি মরুভূমিকে সবুজের জঙ্গলে পরিবর্তিত করার পরিকল্পনা নেয় চিন সরকার। তারা ঠিক করে, মরুভূমির বুকেই সবুজ বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলবে। আর সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হল, ইতিমধ্যে সেই কাজ তারা করেও চলেছে পুরোদমে।
গাছ লাগিয়ে চিন সরকার মরুঝড় আটকানোর চেষ্টা করছে। আর যে কারণে একের পর এক গাছ লাগিয়ে বিস্তীর্ণ জঙ্গল দাঁড় করাতে চাইছে চিন- এই মরুভূমির বুকে। যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে জানা যাচ্ছে, মরুভূমির ৫-১৫% এলাকায় ইতিমধ্যেই তারা সফলভাবে গাছ লাগাতে পেরেছে। একবার ভেবে দেখুন, গোবি মরুভূমি হল অন্যতম শুষ্ক অঞ্চল। এই সকল এলাকায় জঙ্গল তৈরি তো দূর কি বাত, চাষাবাদ করাও কার্যত অসম্ভব। কিন্তু চিন হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়। তাই গবেষকদের সাহায্য নিয়ে, একটা বিস্তীর্ণ জঙ্গল তৈরির পথে হাঁটছে তারা। তার জন্য চিন সরকার দুর্দান্ত দুটো পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একঃ হেলিকপ্টার বা ড্রোন। যার মাধ্যমে আকাশপথেই প্রচুর পরিমাণ বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা এলাকায়। আর অন্যটি হল কৃষকদের উৎসাহিত করা। চিন সরকার নাকি কৃষকদের গাছ লাগানো এবং সেই গাছের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য টাকা দিচ্ছে। গাছ পিছু টাকার অঙ্ক ধার্য করেছে সরকার। ফলে কৃষকদের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়াও চিন সরকার স্কুল পড়ুয়াদের এই গাছ লাগানোর ব্যপারে উৎসাহিত করে আসছে। জানা গিয়েছে, মরুভূমিতে বৃক্ষ রোপণ নাকি বর্তমানে স্কুল প্রোজেক্টের একটা অংশ হয়ে উঠেছে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত মরুভূমির পাঁচ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা সবুজে রূপান্তরিত করেছে চিন।
কৃষিজমি বাঁচানোর জন্য এই ধরণের উদ্যোগ বহু গবেষকদের যথেষ্ট প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু গবেষক আবার চিন সরকারের এই উদ্যোগ দেখে বেশ আতঙ্কিত। তাঁদের বক্তব্য, মরুভূমিতে চিন যে ধরণের বৃক্ষ রোপণ করছে, সেই ধরণের গাছগুলো খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। গাছগুলো মাটির অনেক গভীর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিচ্ছে শিকড়। সেখান থেকে প্রচুর পরিমাণ জল তারা শোষণ করছে। এতে মরুভূমি নয় জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে, কিন্তু সমস্যা দেখা দিতে পারে অন্যত্র। অতিরিক্ত জল শোষণ করার কারণে আবার চাষবাসের জন্য দেখা দিয়েছে জল সংকট। সেই প্রভাব পড়ছে কৃষিজমিতে। তাছাড়া, যে ধরণের গাছ তারা লাগাচ্ছে, সেই গাছগুলো আলাদা করে জঙ্গলের ইকোসিস্টেম ফিরিয়ে আনতে পারছে না। কারণ, গাছগুলোয় তেমন ডালপালা না-থাকার কারণে সেখানে পাখিদের যাতায়াত প্রায় নেই। ফলে, জঙ্গলের যে নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র- সেটার ভালোরকম অভাব দেখা দিয়েছে। তাছাড়া এক ধরণের গাছ লাগানোর অন্য একটা সমস্যা রয়েছে। একটি গাছে যদি বিশেষ কোন অসুখ হয়, তাহলে সমগোত্রীয় হবার কারণে অন্য গাছে ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা দেরি হবে না।
তবে এতো কিছুর পরেও চিন বসে নেই। চিন সরকার নিজেও ঠিক করেছে, অন্যান্য গোত্রীয় গাছ লাগানোর বিষয়ে। তারা যে প্রোজেক্ট বন্ধ করে দিয়েছে সেটাও নয়। বর্তমানে যে পরিমাণ গাছ তারা লাগিয়েছে, তাতে জানা যাচ্ছে, এই জঙ্গলই হচ্ছে মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় বনভূমি। চিন সরকার মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ২০৫০ সাল পর্যন্ত। জানা গিয়েছে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত চিন সরকার মরুভূমিতে গাছ লাগানোর কাজটি করে যাবে। আর সেটা হলে, ৮ কোটি ৮০ লক্ষ একর জুড়ে ছড়িয়ে পড়বে ঘন জঙ্গল। মরুভূমিকে জঙ্গলে পরিণত করার যে প্রচেষ্টা চিন নিয়েছে, তাতে কি চিন কৃষিক্ষেত্রে নিজেদের আর্থিক বিকাশ ধরে রাখতে পারবে? আবহাওয়ার উপর বিরূপ কোন প্রভাব পড়বে নাতো?
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ