Trending
২ লক্ষ কিলো সোনা কিনছে ভারত। ইমপোর্ট করবে ইউএই-র থেকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে মোদী সরকার কেন ইউএই-র থেকে এত পরিমাণ সোনা কিনতে চাইছে? ভারতে কি সোনা কম পড়িয়াছে? তাহলে বলতে হবে একেবারেই না। কারণ ভারতে ইন্ডিভিজুয়াল সাধারণ মানুষের কাছে যে সোনা রয়েছে, সেটা আর পৃথিবীর কোন দেশের মানুষের কাছে নেই। তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ করে এত পরিমাণ সোনা কেন ইমপোর্ট করতে চাইছে? কারণ তো নিশ্চয়ই আছে, আর সেটাও আপনাদের বলব। আসুন তাহলে শুরু করা যাক আজকের প্রতিবেদন।
যেমনটা আমরা বললাম। ভারত সরকার ২ লক্ষ কিলো সোনা ইমপোর্ট করছে ইউএই-র থেকে। আর সেটা আসবে ইউএই-র পোর্ট থেকে সটান গুজরাত পোর্টে। গুজরাতের গিফট সিটি যেটা এখন আন্ডার কনস্ট্রাকশনে রয়েছে, সেই শহরকেই নমিনেট করা হবে ইউএই থেকে ২ লক্ষ কিলো সোনা ইমপোর্ট করার জন্য। এবার বলি গুজরাতের গিফট সিটি আসলে কী? গুজরাতের গান্ধীনগরে তৈরি করা হচ্ছে গিফট সিটি। গিফট সিটি-র ফুল ফর্ম হচ্ছে- Gujarat International Finance Tec-City. এই গিফট সিটির কনস্ট্রাকশন সম্পূর্ণ হলে তখন বুঝতে পারবেন আসলে এটা বিদেশের কোন ব্যস্ত বিজনেস সিটির থেকে কম আকর্ষণীয় হবে না। ইন্টারন্যাশনাল ফিনানশিয়াল সার্ভিস সেন্টার হবে এই গোটা গিফট সিটি। ফিনানশিয়াল এবং আইটি হাব হয়ে উঠবে এই গিফট সিটি যা বলতে গেলে ভারতের মধ্যে প্রথম। কিন্তু ভারত সরকার কেন এত পরিমাণ সোনা কিনতে চাইছে গিফট সিটির জন্য? আসলে শুধু গিফট সিটি নয়। ভারত সরকার সোনা কিনছে ডলারের হাত থেকে ছুটি পাবার জন্য। কারণটা কিছুই নয়। গোটা বিশ্বজুড়ে এখন ডি-ডলারাইজেশনের হাওয়া বইছে। আর যে কারণে মোদী সরকার সেই হাওয়ায় গা ভাসিয়ে নেমে পড়েছে সোনা কেনার জন্য। তবে আপনি যদি মনে করেন যে শুধু ভারত সরকারই এভাবে সোনা কেনার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, তাহলে সেটা বলা খুব ভুল হবে। কারণ, বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ টন টন সোনা কেনার দিকেই ঝুঁকছে। আর যে কারণে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া ২ লক্ষ কিলো সোনা ইমপোর্ট করার দিকে নজর দিয়েছে। এখানেই বলে রাখি, চিন কিন্তু গেল বছর এপ্রিল থেকে প্রায় ১৬০ টন সোনা ইমপোর্ট করেছে। আর যদি ভারতের কথা বলতেই হয়, তাহলে বলতে হবে, কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই ৮০ টন সোনা ইমপোর্ট করেছিল। এখন শুধু ভারত আর চিন নয়। বরং গোটা বিশ্বই ডি-ডলারাইজেশনের পথে হাঁটছে। প্রত্যেকেই চাইছে এবার ধীরে ধীরে ডলার নির্ভরতা কমাতে। আর যে কারণে সোনা কেনার দিকে ঝুঁকছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলো। আচ্ছা, এবার বলি আমরা তো নয় ডি-মনিটাইজেশন পিএম মোদীর আহ্বানে জানতে পেরেছি। কিন্তু ডি-ডলারাইজেশন ব্যপারটা ঠিক কী? আমরা সকলেই জানি যে, গোটা পৃথিবী ফরেন রিজার্ভের জন্য ডলারকে প্রথমেই বেছে নেয়। আর যে কারণে ফরেন রিজার্ভ হিসেবে ডলারের ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর ব্যপারে হাঁটতে চাইছে তারা। কিন্তু ডলারকে ফরেন রিজার্ভ হিসেবে রেখে দেওয়ার ট্র্যাডিশন আজকের নয়। তাই আজ বললেই তো কাল ডলার বা আমেরিকার সঙ্গে যত বন্ড রয়েছে সব ফেলে দেওয়া যাবে না। সুতরাং ডলারের প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে গেলে প্রথমেই যেটা করতে হবে, সেটা হল, ডলারের একটা রিপ্লেসমেন্ট চাই। আর সেটা করতে গেলে, আমাদের প্রয়োজন সোনা। এটাই ডলারের একমাত্র রিপ্লেসমেন্ট হতে পারে। এখন ডি-ডলারাইজেশনের এই যে কনসেপ্ট- সেটা কি একেবারে নতুন? মোটেই না। প্রায় ৪-৫ বছর হয়ে গেল, ডি-ডলারাইজেশনের কনসেপ্ট চালু হয়ে গেছে বিশ্বব্যাপী। আর যে কারণে ভারত তাদের গোল্ড রিজার্ভের পরিমাণ গত ৪,৫ বছর ধরে বাড়াবার কথা ভেবে আসছে। এবং এতদিনে ৩৬% বাড়িয়েও ফেলেছে আরবিআই।
এখন ভারতের হাতে ৫৩০ বিলিয়ন ডলার মত ফরেন রিজার্ভ রয়েছে। যার মধ্যে বেশিরভাগ ডলার। কিন্তু এখন কেন্দ্রীয় সরকার শুধু ডলার নয়, বরং ধীরে ধীরে সোনার পরিমাণও অনেকটা বাড়াতে চলেছে। আগে যে সোনার পরিমাণ ছিল মাত্র ৭-৮%, এখন সেটা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ১০-১২ শতাংশে। কিন্তু ঐ- প্রশ্ন হচ্ছে যে কেন ডলার নিয়ে এত ঝঞ্ঝাট? এখানেই বলি আসল কথা। বিশ্বব্যাপী সকল সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক তিনটে পথেই নিজের ফরেন রিজার্ভের অঙ্ক বাড়ানোর কথা ভাবে। তার মধ্যে এক- ডলার বা মার্কিন মুলুকের সঙ্গে থাকা যাবতীয় বন্ড বা ইউএস ট্রেজারি বিল, দুই- ইউরো এবং তিন- সোনা। আমরা সকলেই জানি, ডলার কিন্তু ইউরোকেও ভালোভাবে বিট করেছে অনেকদিন। এখন ইউরোর থেকেও ডলারের বাজার দখল করার ক্ষমতা অনেক বেশি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে অন্য জায়গায়। বহু আর্থিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, আগামী দু’এক বছরের মধ্যেই ভালোরকম পতন দেখতে পারে ডলার। তার জন্য সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কগুলোর ডলারের প্রতি উদাসীনতা দেখানো একটা কারণ বলে মনে হতে পারে। ১৯৪৪ সালে প্রথম ব্রেটন উডস এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে ডলারকে রিজার্ভ কারেন্সির স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারপর থেকে ডলারের উত্থান শুধু হয়েছে। একচেটিয়া ডলারের আধিপত্য বজায় থেকেছে ভালোরকম। আর যে কারণেই ডলারের হাত থেকে রেহাই পেতে এবার অন্যান্য দেশের মত ভারত সরকার ২ লক্ষ কিলো সোনা কেনার দিকে ঝুঁকেছে। বলা হচ্ছে, এই গিফট সিটি প্রথম ইন্টারন্যাশনাল বুলিয়ন এক্সচেঞ্জ হবে। আর এটাই সোনা ইমপোর্ট করার সবথেকে বড় এন্ট্রি গেট হতে পারে। মনে করা হচ্ছে, দেশে যত সোনা আসবে সব এখান দিয়েই আসবে। এই গিফট শহরেই সোনার দাম ঠিক করা হবে যা কিনা ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডের নিরিখে করা হবে বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ গিফট সিটি আগামীতে ভারতের মেন ইমপোর্ট পয়েন্ট হয়ে উঠতে পারে। আর সেটাই হতে চলেছে ২ লক্ষ কিলো সোনা ইমপোর্ট করার মাধ্যমে। এখানেই একটা বিষয়। ভারত যত সোনা কেনে, সেটা কাস্টমসের মাধ্যমে হয়ে থাকে। গিফট সিটিতে আইআইবিএক্স বা ইন্ডিয়া ইন্টারন্যাশনাল বুলিওন এক্সচেঞ্জ (India International Bullion Exchange) রয়েছে। ফলে সোনা, কপার বা রুপোর মত ধাতু যখনই গিফট সিটির মাধ্যমে নিয়ে আসা হবে, তারপর সেটা গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়তে অনেকটাই কম সময় লাগবে। তাছাড়া এখানে সোনার মত হলুদ ধাতুর দামও অনেকটা কম হবে। আমরা যদি সোনা মজুদ রাখার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রথম দশটি দেশের লিস্ট বের করি, তাহলে বলব, সবার প্রথমে রয়েছে আমেরিকা। তারপর রয়েছে জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সের মত দেশ। ভারত রয়েছে নয় নম্বরে। আটে রয়েছে জাপান এবং দশে রয়েছে নেদারল্যান্ড। জানা যাচ্ছে, ২ লক্ষ কিলো সোনা ভারতের হাতে এসে গেলে, তখন জাপানকে পিছনে ফেলে আট নম্বরে চলে আসবে ভারত।
এবার শেষ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাক। ইউএই- যে দেশ কিনা তেলের খনি, তার কাছে সোনার খনি এতো? সেটা কি করে হয়? তাহলে বলতে হবে ইউএই-র কাছে কোন সোনার খনিই নেই। বরং সোনার খনি রয়েছে সুদূর আফ্রিকায়। আফ্রিকার সুদান, মিশর, লিবিয়া, মালি, নাইজেরিয়া, ঘানা, তানজানিয়া বা উগান্ডার মত দেশে রয়েছে প্রচুর সোনার খনি। সেই খনিগুলো থেকে সোনা মাইনিং করার জন্য ইউএই আফ্রিকার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে রেখেছে। আফ্রিকার আভ্যন্তরীণ অবস্থার কথা আমরা সকলেই জানি। সেখানকার সাধারণ মানুষদের ন্যূনতম পারিশ্রমিক দিয়ে সোনা তোলার কাজ করানো হয়। তারপর মাফিয়া রাজ তো রয়েছেই। এই সব নিয়ে আফ্রিকার আভ্যন্তরীণ অবস্থা বেশ টলোমলো। সেই ঝামেলায় নিজেকে জড়াতে চায় না ভারত। আফ্রিকার থেকে এই কাজটাই করে ইউএই। তারা নিজেদের কাছে সোনা তুলে নিয়ে আসে। তারপর সেই সোনা শুদ্ধিকরণের কাজ করে ইউএই। কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। সেই ঝামেলা বরং নিক ইউএই। তাদের থেকেই ভারত ২ লক্ষ কিলো সোনা কিনবে। আর এখানেই কিন্তু ইতি নয়। ভারত ভবিষ্যতে আরও লক্ষ লক্ষ সোনা ইমপোর্ট করবে ইউএই থেকে। তারপর ডিসকাউন্টে সেটা বিক্রি করা হবে ডোমেস্টিক পারপাসে। আর সেই সোনা কিনবে ভারতের জুয়েলারি সেক্টর। এর ফলে একদিকে ডলার নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে দেশবাসীর হাতে সোনা বেশি পরিমাণে থাকবে। সবমিলিয়ে ডলারকে টেক্কা দেবার জন্য এটাই হল মোদী সরকারের মাস্টারপ্ল্যান।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ