Daily
এখানকার মন্দিরগুলোর সামনে দাঁড়ালে মনে হবে আপনি চোখের পলকে পৌঁছে গেলেন আদি বাংলায়। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে। যখন বৌদ্ধ, জৈন, শৈব ধর্মের প্রভাব ছিল গোটা বাংলা জুড়ে। সেই ধর্মেরই স্মারকচিহ্ন হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে রয়েছে এখানকার অধিকাংশ মন্দিরগুলি। মন্দিরের স্ট্রাকচার দেখলে বোঝা যায় কোনটা তৈরি বৌদ্ধ ধর্মের আদলে। কোনটা তৈরি জৈন ধর্মের আদলে। আর কোনটি শৈব ধর্মের আদলে। যে বাংলার ধর্মীয় ইতিহাস বাংলাকে কালে-কালে সমৃদ্ধ করেছে, যে মন্দিরগুলি একেকটি বহন করছে সেই প্রাচীনত্বের স্মারক, আজ সেই সকল মন্দিরগুলির প্রতি দেখা যাচ্ছে চরম উদাসীনতা। যে-সকল পর্যটকদের ম্যাপে এই জায়গাটি ঠাঁই পায়, তাঁরা ব্যতীত খুব একটা কেউ আসেন না, এই প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষী থাকতে। আজ আমরা এসেছি এমনই একটি জায়গায়, যাকে মন্দির নগরীও বলা যায় নির্দ্বিধায়। নাম দেউলঘাটা, জেলা পুরুলিয়া।
আসলে পুরুলিয়া জেলা জুড়েই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন মন্দির, দেবদেবীর মূর্তি, স্থাপত্য। ছত্রে ছত্রে রয়েছে অতীতের অনেক ইতিহাস, সংস্কৃতি। তারই সংক্ষিপ্ত নিদর্শন হল এই দেউলঘাটা। পুরুলিয়া শহর থেকে ৩৪-৩৫ কিলোমিটার পশ্চিমে গেলেই পেয়ে যাবেন মন্দির, স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের এই পীঠস্থান। যার প্রত্নতাত্ত্বিক ভ্যালু দিনেদিনে শুধু বেড়েছে। মূলত পুরুলিয়া জেলার নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে ছড়িয়ে রয়েছে এমন অসংখ্য মন্দির, ভাস্কর্য। যেগুলোর মধ্যে স্পষ্ট জৈন এবং বৌদ্ধ ইনফ্লুয়েন্স। তবে দেউলঘাটায় আনুমানিক নবম, দশম শতকে এই এলাকা জুড়ে যে মন্দিরগুলি নির্মাণ করা হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে আজ টিকে রয়েছে কোনমতে মাত্র দুটি। একেকটি মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৭০-৮০ ফুট। ভালো করে দেখলে বুঝবেন, মন্দিরের গঠন কিছুটা প্যাগোডার মতন। মনে করা হয়, মহাযানীরা এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। মহাযানী বলতে একটু ছোট্ট করে বিষয়টা বলে দিই। গৌতম বুদ্ধের নির্বাণের পর বৌদ্ধ ধর্ম দুটি শাখায় ভাগ হয়ে গেছিল। একটি হীনযান এবং অন্যটি মহাযান। মহাযান শাখার বৌদ্ধরা তন্ত্রসাধনাকে খুব গুরুত্ব দিতেন। যে-কারণে বাংলার তন্ত্রেও বৌদ্ধ তন্ত্রের প্রভাব প্রাচীনকাল থেকে রয়েছে। টেরাকোটার আদলে তৈরি এই দেউলগুলির গায়ে নজর দিলে সেকালের শিল্পীদের দক্ষতার সঙ্গে আপনার পরিচয় ঘটবে। বিভিন্ন ফল, ফুল, লতাপাতা, জীবজন্তু, দেবদেবীর মূর্তি গোটা মন্দিরের শৈল্পিক উৎকর্ষতা অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
পুরাতাত্ত্বিক গবেষকরা বলছেন, সেই সময় নদীগুলিই ছিল যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ফলে জলপথে ব্যবসা হত সবথেকে বেশি। কাঁসাই বা কংসাবতী, দামোদর নদীকে কেন্দ্র করেই তখন ব্যবসাবাণিজ্য চলত রমরমিয়ে। আর সেই সময়েই জৈন ধর্মাবলম্বী ব্যবসায়ীরা নিজেদের সংস্কৃতিকে আরও ছড়িয়ে দেবার জন্য নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলোয় মন্দির, স্থাপত্যগুলি গড়ে তোলেন। তেমনই একটি সিদ্ধস্থান পুরুলিয়ার আরশা থানার বড়াম মৌজায় কাঁসাই নদীর তীরের এই দেউলঘাটা। এই বিষয়ে কী বললেন জেলার বিশিষ্ট লোক গবেষক ড. দয়াময় রায়?
ইতিহাসের পাতায় জীর্ণ হয়ে ওঠা মন্দিরগুলো নিঃসন্দেহে বাংলার ইতিহাসকে তুলে ধরে। কিন্তু উদ্যোগ এবং উৎসাহের অভাবের জন্য আজ মন্দিরের চারপাশে গজিয়ে উঠেছে বড় বড় গাছ, বেড়েছে আগাছার জঙ্গল। যে সকল মন্দিরের ইতিহাস বাংলার পাতাতেই বিবর্ণ, সেই সকল মন্দিরের কথা কতটাই বা মনে রাখবেন এখনকার হুজুগে বাঙালি? তবে পুরুলিয়া ঘুরতে আসেন যারা, এবং যারা এই মন্দিরনগরীর ইতিহাস সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন, তারা কিন্তু একবার না-একবার ঢুঁ মারবেনই এই দেউলঘাটায়।
দেউলঘাটার মন্দির চত্ত্বরে পাওয়া গেছে বেশ কিছু মূর্তি, ভাস্কর্য। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণেশের মূর্তি, অষ্টদল মূর্তি, শিবলিঙ্গ, মা ভৈরবীর মূর্তি, মহিষমর্দিনী দশভুজা। এই মূর্তিগুলো একদিকে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এবং নিত্য পুজোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক। এই মন্দিরনগরী প্রাচীন বাংলার ইতিহাসের সঙ্গী। তাই অনেকেই মনে করছেন, এই প্রত্নস্থলের শিল্পস্থাপত্যগুলি রক্ষণাবেক্ষণ না-হলে একদিকে যেমন স্থাপত্য, ভাস্কর্য তথা জেলার সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে তেমনি চিরকালের মতো হারিয়ে যেতে পারে পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার এই মূল্যবান সম্পদ। সংরক্ষিত করে এটিকে পর্যটক এবং গবেষকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু তৈরি করতে হবে। না-হলে কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে বাংলার প্রাচীন অধ্যায়ের এই নিদর্শন।
সন্দীপ সরকার
পুরুলিয়া