Trending

মানুষ কল্পনাবিলাসী। আমি, আপনি- আমরা সকলেই কল্পনার স্রোতে ভাসি। সেই কল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞানের মিশেল হলে তখন সেটা হয় কল্পবিজ্ঞান। কিন্তু অতীতে যা কল্পবিজ্ঞান, ভবিষ্যতে সেটাই হয়ে দাঁড়ায় বাস্তব। সৌজন্যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ধারাবাহিক উন্নতি। না-হলে বলুন না, যে হাইড্রোজেনের কথা আমার-আপনার মতন সাধারণ মানুষ ঐ ফিজিক্স, কেমিস্ট্রির বইতে পড়েছে, জলের বিজ্ঞানে জেনেছে, শুনেছে, আজ সেই হাইড্রোজেন নাকি টেনে নিয়ে যাবে ট্রেনের মত একটা এতো বড় যন্ত্রদানবকে? গ্যালন গ্যালন তেল বা ইলেকট্রিকের ক্ষমতা থাকতে পারে, অতবড় ট্রেনটাকে টেনে নিয়ে যাবার। কিন্তু তাই বলে হাইড্রোজেন? খানিক কল্পনা হতে পারে, ভ্রম বলেও মনে হতে পারে। তবে এটাই সত্যি করতে চলেছে এবার ভারতীয় রেল মন্ত্রক। এই বিষয়ে ভারত পায়োনিয়ার- সেটা বলাটা ভুল হবে। কারণ জার্মানি এবং চিন সেই কল্পনাকে বাস্তবতায় টেনে নামিয়ে এনেছে। তবে এটাও তো ঠিক যে, বিশ্বের আর কোন দেশ হাইড্রোজেন ট্রেনের কথা এখনো পর্যন্ত ভাবতে পারেনি। সুতরাং ভারত যখন হাইড্রোজেন ট্রেন নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে, তখন তৃতীয় খেলোয়াড় হিসেবে ভারতের নাম তো আসবেই। আবারও বিশ্বমঞ্চে নিজেকে এক ধাপ তোলার মোক্ষম সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হল, হাইড্রোজেন ট্রেন আসলে কী? হাইড্রোজেনের মাধ্যমে সত্যিই কি ট্রেন চলতে পারে? আজ এই সব বিষয়গুলো নিয়েই নাড়াঘাঁটা করব প্রতিবেদনে।
ভারতের মাটিতে জালের মতন ছড়িয়ে রয়েছে রেল ট্র্যাক। হাজার হাজার স্টেশন, কোটি কোটি যাত্রী। বিশ্ব পরিবহনের অন্যতম সর্ববৃহৎ সেক্টর ভারতীয় রেল। নিত্যযাত্রীদের জন্য রেলের বিকল্প মনে হয় আর কিছু নেই। আর গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি এমপ্লয়ি রয়েছে ভারতীয় রেলে। কিন্তু গোটা বিশ্ব আজ প্রযুক্তিকেই হাতিয়ার করে এগোচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি মানে সেটা অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব বা ইকো ফ্রেন্ডলি- অন্যদিক থেকে। যে দেশ যত তাড়াতাড়ি ইকো ফ্রেন্ডলি নতুন নতুন টেকনোলজি নিয়ে হাজির হবে, সেই দেশ সকলের মাঝে সমীহ এবং শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি করে নেবে সহজে। যে কোন দেশের রেল পরিবহন ব্যবস্থা যাতায়াতের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। কিন্তু ডিজেল বা ইলেকট্রিকে চলা ট্রেনে দূষণ তো কম ছড়ায় না। আর প্রতিদিন যেখানে এতো এতো ট্রেন যাতায়াত করে, সেখানে দূষণের জেরে আরও ক্ষতবিক্ষত হবে আমাদের এই নীল গ্রহ। তাই বেশ কিছুদিন আগেই জার্মানি এবং চিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রেল পরিবহনে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। যে পরিবর্তন রেল ব্যবস্থাকে একেবারে পাল্টে দেবে চিরতরে। জিরো কার্বন এমিশন রেল। সেই পথেই পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে তারা। কয়লা, ডিজেল, বিদ্যুতের পর কাকে চালিকা শক্তি করা যেতে পারে? অবশেষে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করার পর তারা ঠিক করে হাইড্রোজেনই টেনে নিয়ে যাবে এই যন্ত্রদানবকে। তবে হ্যাঁ। তার জন্য ট্রেনের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন আসবে। অবশেষে ২০১৮ সাল নাগাদ জার্মানিতে প্রথম দু’কামরা ছোট্ট এই নীল রঙা ট্রেনটি চলতে শুরু করে। দেখতেও যেমন সুন্দর, জার্নিও নাকি তেমন আরামের। আর এই ট্রেনটি চলছে হাইড্রোজেনে। এই ট্রেনের সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ট্রেনটি সম্পূর্ণ ইকো ফ্রেন্ডলি। সুন্দর দেখতে এই ট্রেনটি তৈরি করেছে ফ্রান্সের অ্যালস্টম। ট্রেনটি বহাল তবিয়তে যাত্রাও করেছে জার্মানির বুক্সটেহুড, ব্রেমেরভয়রদে, ব্রেমেরহ্যাভেন এবং কুক্সহ্যাভেন দিয়ে। যাত্রাপথ ছিল সুদীর্ঘ ১০০ কিলোমিটার। এখন বিষয়টা হচ্ছে, ট্রেনের চালিকা শক্তি হিসেবে কি করে কাজ করবে হাইড্রোজেন? খুব সহজ বিজ্ঞান। হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেনের মিশ্রণে তৈরি হবে তড়িৎশক্তি। সেটাই ব্যবহার করা হবে জ্বালানি হিসেবে। বাড়তি শক্তি জমা থাকবে এই ট্রেনের উচ্চক্ষমতার ইওন ব্যাটারিতে। বলা হচ্ছে, একটি হাইড্রোজেন ট্যাঙ্ক থেকে যে পরিমাণ শক্তি তৈরি হবে, তাতে ১ হাজার কিলোমিটার পথ নিশ্চিন্তে পাড়ি দেবে এই ট্রেন। পরিবর্তে ট্রেন থেকে বেরোবে শুধু জলবিন্দু আর অক্সিজেন।
এখানেই একটা বিষয় আপনাদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। হাইড্রোজেন কিন্তু অনেক রকম হয়। জীবাশ্ম জ্বালানী থেকে যে হাইড্রোজেন উৎপন্ন হয়, সেটা গ্রে হাইড্রোজেন। এই হাইড্রোজেন আমরা সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পেয়ে থাকি। প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে যে হাইড্রোজেন পাওয়া যায়, সেটা ব্লু হাইড্রোজেন। আর সূর্যের আলোকে ব্যবহার করে জলের তড়িৎ বিশ্লেষণ করলে আমরা যে হাইড্রোজেন পেয়ে থাকি, সেটা গ্রিন হাইড্রোজেন। এই গ্রিন হাইড্রোজেন ব্যবহার করেই ট্রেন চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে একটা বিষয়। গ্রিন হাইড্রোজেনে ট্রেন চালানো হলে পরিবহনে নয়া দিশা দেখতে পাবে ভারত। একইসঙ্গে দেখাতে পারবে গোটা পৃথিবীকে। গ্রিন হাইড্রোজেনকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করলে নাকি খরচ অনেকটাই কমে যাবে। সেটা ডিজেল বা ইলেকট্রিক যাই বলুন না কেন। আর খরচ কমা মানে রাজকোষ থেকে কম খরচ। ফলে এই যে পেট্রোপণ্য কিনতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার ভারত সরকারকে খরচ করতে হয়, সেই টাকা থেকে যাবে আমাদের রাজকোষে। অনেক বিশেষজ্ঞ তো বলছেন, গ্রিন হাইড্রোজেন যদি পরিবহনের ৫০% ব্যবহার করা হয়, তাহলেও বছর শেষে লাভ থাকবে প্রায় দেড় লক্ষ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ট্রেন চালানোর এই প্রযুক্তি বাইরে থেকে নেওয়া হবে না। তাঁর নির্দেশ মতনই, একেবারে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি করা হবে হাইড্রোজেন ট্রেন। আর সবথেকে বড় কথা, বাংলার ভাগ্যেও কিন্তু জুটে যেতে পারে একটি হাইড্রোজেন ট্রেন। কোথায় চলবে জানেন? বাংলা তথা ভারতের অন্যতম হেরিটেজ সাইটে। চলবে আমাদের শৈল শহর দার্জিলিং-এ। পাহাড়ের বুক চিরেই নাকি ছুটতে দেখা যাবে এই ট্রেনকে। এমনই জানিয়েছেন, রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব।
হাইড্রোজেন ট্রেন আনার পরিকল্পনা চলতি বছরেই রয়েছে। জোর কদমে চলছে সেই প্রস্তুতি। সব যদি ঠিক থাকে, তাহলে হাইড্রোজেন ট্রেনে করে সফর আর খুব বেশিদিনের অপেক্ষা হবে না। একইসঙ্গে জার্মানি এবং চিনের সঙ্গে ভারত বিশ্বের তৃতীয় দেশ হিসেবে ঢুকে পড়বে এই ক্লাবে। জানা গিয়েছে, গোটা বিশ্বেই নাকি হাইড্রোজেন ট্রেনের চাহিদা ঊর্ধ্বমুখী। জার্মানি ছাড়াও ব্রিটেন, কানাডা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, ইতালি এবং নেদারল্যান্ড নাকি হাইড্রোজেন ট্রেন চালানোর পরিকল্পনা করছে। সেই তালিকায় নাম রেখেছে ফ্রান্স নিজেও। তবে আপাততর জন্য জার্মানি এবং চিনের পর ভারতই হতে চলেছে তৃতীয় দেশ, যে হাইড্রোজেন চালিত ট্রেনের মাধ্যমেই উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে আবারও গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম কাঁপাবে ভারত।
বিজনেস প্রাইম নিউজ।
জীবন হোক অর্থবহ