Story
আগাছায় জন্মানো গাছ জাতে ওঠে লাভের মুখ দেখিয়ে। সেই লাভে যখন সংসার চলে তখনি তার গা থেকে মোছে আগাছায় বড় হওয়ার বদনাম। এখন কপালে জোটে পরিচর্যা আর লালন পালনের মত সৌভাগ্য।
হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন। রেল লাইনের ধার কিম্বা ফাঁকা মাঠে, ঝোপে ঝাড়ে বড় অযত্নে বেড়ে ওঠা ফুলের নামই আকন্দ। সেই আকন্দ ফুলের চাষ করেই সংসার চালান গাইঘাটার প্রায় আড়াইশো থেকে তিনশো ফুল চাষি।
গাইঘাটা ব্লকের সুটিয়া পঞ্চায়েতের পাঁচপোতা, সিঙেরডাঙা, ঘোষপাড়া সহ আশপাশের বিভিন্ন গ্রামে বিঘের পর বিঘেতে এখন শুধুই মাঠ ভর্তি ফুলের চারা। সকালে আর বিকালের বাতাসে হাওয়ায় দুলে দুলে ফুলগাছ গুলো যেন বলে চলেছে আমরা আছি বলেই তোমরা আছ।
চৈত্রের শেষে এখন মাঠে মাঠে ফুলচাষিদের চূড়ান্ত ব্যস্ততার পালা। ব্যস্ততা অবশ্য শুরু হয়েছে সেই শ্রাবণ মাস থেকে। ফাল্গুনের শিব চতুর্দশী ধরে চৈত্রের শেষে নীলের পুজোতেই ঘরে তুলতে হবে সারা বছরের রসদ। তাই মাঠ থেকে বস্তায় ফুল ভরে নিয়েই ফোনে যোগাযোগ করছেন চাষিরা বাজারের পাইকারদের সঙ্গে।
প্রায় ২০ বছর আগে রোজগেরে জীবনে ব্রাত্য ফুলকে সুটিয়ার মাটিতে জীবনের অঙ্গ করে তোলেন ফুলচাষি কুমার সরকার। সেই থেকে শুরু। আর পিছনে ফিরে তাকান নি এখানকার প্রায় শ’তিনেক ফুলচাষি। কুমারবাবুর দেখানো পথ ধরেই এখানকার প্রায় ৭০০ বিঘা জমিতে আকন্দ ফুলের ব্যবসা হয়ে উঠেছে রোজগারের প্রধান মাধ্যম। একমাস ধরে কঠোর ব্রত পালন করার পর ভক্তরা যান বাবার মাথায় জল ঢালতে। বাবার প্রিয় সেই ফুলেই জীবনে বাঁচার ছন্দ খুঁজে পান এখানকার খুকুমণি সর্দার, চম্পা দাসেরা। ফুল যে শুধু কয়েকশো পরিবারের বাঁচার রসদ, তাই নয়। এই ফুলেই রয়েছে অনেক রকমের ওষধি গুনও। তাই ফুলের ব্যবসা যথেষ্ট লাভজনক। স্বচ্ছলতার সন্ধানও।
আকন্দ ফুল চাষ লাভজনক মূলত দুটি কারণে। একে একই গাছ থেকে টানা ১০ বছর ফুল পাওয়া যায়। অন্যদিকে এই গাছের পরিচর্যাতেও অন্যান্য গাছের মত পরিপালনে ব্যয় অনেকটাই কম হয়। তাই আকন্দ ফুল চাষে রাজ্যের মধ্যে অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠেছে গাইঘাটার সুটিয়া গ্রাম।
শুধু ফুল চাষই হয় না। ফুল চাষের সঙ্গে এখানকার গ্রামের বাড়ি বাড়িতে মালা গাঁথা হয়ে উঠেছে কুটির শিল্পের মত। মালা পিছু এখানকার মহিলারা ঘরে বসে আয় করেন সাত টাকা। সংসারের কাজকর্মের ফাঁকে মহিলারা তাঁদের মেয়েদেরকেও জুটিয়ে নেন এই কাজে।
এক ফুলকে কেন্দ্র করে এখানে যেমন গড়ে উঠেছে মালার বাজার তেমনি প্রতিটি জমিতে মহিলারা বালতি পিছু ফুল তুলে রোজগার করেন দু’ থেকে তিন ঘণ্টার অবসরে ১৫ টাকা। শুধু রোজগারই আছে এমন নয়। রোজগারের পথে কাঁটাও আছে। ফুলের আঠা চোখে গেলে প্রায় সপ্তাহখানেক আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায় এখানকার মহিলাদের। কিন্তু তবুও পেট বড় বালাই। কষ্টের সংসারে এটুকু রোজগারই বা আসে কোথা থেকে।
হাতে প্লাস্টিক জড়িয়ে, মুখ ঢেকে মহিলারা চড়া রোদে দাঁড়িয়ে ঘণ্টা তিনেকের পরিশ্রমে যেমন এখান থেকে আয় করেন তেমনি কৃষককেও সেই ফুল গাইঘাটার ঠাকুরনগরে ফুলের বাজারে পৌঁছতে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়।
তবে এখন আর আগের মত লাভ নেই। লাভের বহর কমলেও হাতে কিন্তু মন্দ পড়ে থাকে না। সার, কীটনাশক, চারা, মালার খরচ সব মিলিয়ে এক বিঘা জমিতে খরচ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা। আর এক বিঘা জমির ফুল বাজারে বিক্রি হয় ১ লক্ষ টাকায়। তবে শীতকালে ফুল বেশি ফোটে না বলে সেই সময় ফুলের বাজারদর ওঠে সপ্তমে।
শ্রাবণ মাস থেকে শুরু করে শিবরাত্রি হয়ে নীল পুজো- বাঙালির নিত্য পুজোড় বাজারে আকন্দর মালা এখন সবসময়েই দেখা যায়। আর বাবার ভক্তরা তো আকন্দ ছাড়া বাবার পুজো ভাবতেই পারেন না। পতিত জমিতে অযত্নে, অবহেলায় বড় হওয়া আকন্দ এখন ফুলের বাজারে জোর কদমের জাঁকিয়ে বসেছে চাষযোগ্য ফুলের তকমা নিয়ে।
দেবস্মিতা মণ্ডল, উত্তর ২৪ পরগণা